পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাস মানব সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। প্রাচীনকাল থেকে যখনই মানুষ কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে, নতুন আবিষ্কার করেছে বা প্রযুক্তিগত উন্নতি করেছে তখনই বিজ্ঞানের এই শাখা সমৃদ্ধ হয়েছে। আলোচনার সুবিধার্থে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি।
প্রাচীন যুগ:
প্রাচীন সভ্যতার যুগে মানুষ পদার্থবিজ্ঞানে বেশ কিছু অগ্রগতি করেছিল। যেমন:
- মেসোপটেমিয়ানরা সময় পরিমাপের জন্য সূর্যঘড়ি এবং জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত জ্ঞান ব্যবহার করত।
- মিশরীয়রা পিরামিড তৈরিতে জ্যামিতি এবং ভারসাম্য সম্পর্কিত ধারণা কাজে লাগিয়েছিল।
- তবে কিছু গ্রিক দার্শনিক প্রাচীন বিশ্বাসের গন্ডি পেরিয়ে প্রকৃতিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা শুরু করেন। যেমন:
থেলিস (খ্রিস্টপূর্ব ৬০০): প্রকৃতির ঘটনা বোঝার জন্য বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
পিথাগোরাস (খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০-৪৯৫): গণিত ও পদার্থের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন।
ডেমোক্রিটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৭০): “পরমাণু” ধারণা প্রস্তাব করেন।
অ্যারিস্টটল (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২): বস্তু, গতি, এবং মহাকাশের গঠন সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা দেন। তাঁর ধারণাগুলো মধ্যযুগ পর্যন্ত বিজ্ঞানের উপর প্রভাব বিস্তার করে।
মধ্যযুগ (৫ম-১৫শ শতাব্দী):
মধ্যযুগে বেশ কিছু আরবীয় ও ইউরোপীয় বিজ্ঞানীর হাত ধরে পদার্থবিজ্ঞান বেশ অনেকটা এগিয়ে যায়।
আল-হাসান ইবন আল-হাইথাম (৯৬৫-১০৪০): আলোকবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি “কিতাব আল-মানাজির” গ্রন্থে আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ ব্যাখ্যা করেন।
আল-বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮): অভিকর্ষ শক্তি এবং পৃথিবীর ঘূর্ণন নিয়ে কাজ করেন।
ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭): পদার্থ ও গতির উপর গভীর বিশ্লেষণ করেন।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান (২০শ শতাব্দী):
নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩): সূর্যকেন্দ্রিক ধারণার প্রবর্তন করেন।
গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২):
গতি এবং বস্তুর পতন নিয়ে পরীক্ষা চালান।
প্রথম টেলিস্কোপ ব্যবহার করে জ্যোতির্বিদ্যা পর্যবেক্ষণ করেন।
আইজ্যাক নিউটন (১৬৪৩-১৭২৭):
“প্রাকৃতিক দর্শনের গণিতীয় নীতিমালা” (Principia) গ্রন্থে নিউটনের গতিসূত্র এবং অভিকর্ষ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন।
তাঁর কাজ পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি রচনা করে।
জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (১৮৩১-১৮৭৯): তড়িৎচুম্বক তত্ত্ব প্রদান করেন।
মাইকেল ফ্যারাডে (১৭৯১-১৮৬৭):তড়িৎ ও চুম্বকের সম্পর্ক আবিষ্কার করেন।
কার্নো, জুল এবং থমসনের কাজের মাধ্যমে শক্তির সংরক্ষণ সূত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫):
আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (Special and General Relativity) প্রদান করেন।
E=mc² সূত্রের মাধ্যমে ভর ও শক্তির সম্পর্ক দেখান।
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক (১৮৫৮-১৯৪৭): কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন।
নীলস বোর (১৮৮৫-১৯৬২): পরমাণুর গঠন ও কোয়ান্টাম মডেল ব্যাখ্যা করেন।
হাইজেনবার্গ ও স্রোডিঞ্জার: কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে কাজ করেন।
বর্তমান যুগ (২১শ শতাব্দী):
বর্তমান পদার্থবিজ্ঞান অত্যন্ত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। হিগস বোসন কণার আবিষ্কার, ন্যানোটেকনোলজি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, কৃষ্ণগহ্বর এবং মহাবিশ্বের প্রসারণ নিয়ে গবেষণা ইত্যাদি হয়তো ভবিষ্যতে সকল প্রাকৃতিক ঘটনাকেই বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হবে।
যা হউক সবশেষে আমরা এটাই বলতে পারি যে পদার্থবিজ্ঞানের উন্নয়ন মানেই মানব সভ্যতার উন্নয়ন।