২৮শে জুলাই ১৯১৪ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরি এবং সার্বিয়ার মধ্যে প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়। ফার্ডিনান্ডের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার অন্তরালে সার্বিয়াকে দখল করাই অস্ট্রো-হাঙ্গেরির উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এই যুদ্ধে অনেক দেশ অংশগ্রহণ করে তাকে মহাযুদ্ধে পরিণত করে। এই পর্বে আমরা কীভাবে এবং কেন বিভিন্ন দেশ মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তা নিয়ে আলোচনা করব।
সার্বিয়াকে আক্রমণ করার পর রাশিয়া সার্বিয়াকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে। ৩০শে জুলাই ১৯১৪ রাশিয়া সার্বিয়াকে সাহায্য করতে সেনা পাঠায়। কারণ হিসাবে বলা যায়, সার্বিয়াতে রুশভাষী জনগোষ্ঠী বাস করত। রুশভাষী জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে রুশভাষী রাশিয়ারা এগিয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এর পিছনে অন্য কারণও ছিল। আসলে তখন অত্যাচারী জার শাসকদের পতন ঘটানোর জন্য রাশিয়াতে বিদ্রোহ চলছিল। জার শাসকরা জনগণের দৃষ্টি যুদ্ধের দিকে ঘুরিয়ে দেন বিদ্রোহ কমানোর জন্য।
মৈত্রী জোটের শর্তানুসারে জার্মানি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিকে সামরিক শক্তি দিয়ে সাহায্য করবে। তাই জার্মানির যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেই হতো। আর জার্মানদের আধুনিক মরণাস্ত্রসহ মোট ৪৫ লক্ষ্য সৈন্য ছিল। এই বিপুল সেনাবাহিনী যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারে। শক্তি প্রদশর্নে তাদের কোন ভয় নেই। অর্থাৎ তাদের উগ্র মন-মানসিকতা তাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করায়।
তখন জার্মান সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় উইলিয়াম কাইজার। ১ আগস্ট ১৯১৪, জার্মান অস্ট্রো-হাঙ্গেরীকে সমর্থন করে। রাশিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় সম্রাট কাইজার বেশ চিন্তায় ছিলেন। কারণ যদি তিনি এখন সার্বিয়াকে সাহায্য করে তবে শক্তিশালী রাশিয়ার সাথেও যুদ্ধ করতে হবে। তাই তিনি রাশিয়াকে সৈন্য প্রত্যাহার করার জন্য চরমপত্র পাঠায়। রাশিয়া এতে মোটেই কর্ণপাত করেনি। ফলে জার্মান সম্রাট উইলিয়াম কাইজার রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
খেয়াল করুন অস্ট্রো-হাঙ্গেরি এবং সার্বিয়ার মধ্যকার যুদ্ধ রাশিয়া এবং জার্মানিকেও টেনে নিয়ে এসেছে।
ফ্রান্স রাশিয়ার মিত্র। তাই ফ্রান্স রাশিয়ার পক্ষে লড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে ২ আগস্ট ১৯১৪, জার্মান সম্রাট উইলিয়াম কাইজার ফ্রান্স কোন পক্ষে থাকবে তা জানতে পত্র পাঠায়। ফ্রান্স বলে যদি সে অংশগ্রহণ করে তবে সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবে। এতে জার্মান ভাবে ফ্রান্স হয়ত রাশিয়ার পক্ষেই লড়বে। আর যদি তাই হয় তবে পূর্ব দিকে রাশিয়া ও পশ্চিম দিকে ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। তাই তিনি প্রথমে ফ্রান্সকে দখল করে পরে রাশিয়াতে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে।
ফ্রান্স আক্রমণ প্রতিহত করতে জার্মানির সীমান্তে ১০ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করে। জার্মানি চিন্তা করে ১০ লক্ষ সৈন্যর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ করলে ক্ষয়-ক্ষতি বেশি হবে। তাই তিনি বেলজিয়ামের মধ্য দিয়ে গিয়ে ফ্রান্সকে দখল করার পরিকল্পনা করে। সম্রাট কাইজার বেলজিয়ামের রাজা আলবার্টকে পত্র পাঠায় যেন আলবার্ট তার দেশের মধ্য দিয়ে ৪ লক্ষ সৈন্যকে ফ্রান্স আক্রমণ করতে দেয়। এতে বেলজিয়ামের যা ক্ষয়ক্ষতি হবে তা জার্মান বহন করবে। কিন্তু বেলজিয়ামের রাজা আলবার্ট রাজি হয়নি। কারণ তিনি ভাবেন যদি ৪ লক্ষ জার্মান সৈন্য বেলজিয়ামে ঢুকে পরে তবে তারা বেলজিয়ামের ১ লক্ষ ১৭ হাজার সৈন্যকে পরাজিত করে বেলজিয়াম দখল করতে পারে। যা হউক জার্মান সৈন্যরা বেলজিয়ামের সৈন্যদের বাধাকে তোয়াক্কা না করেই বেলজিয়াম ঢুকে পরে।
৩ আগস্ট ১৯১৪, বেলজিয়াম সাহায্যের জন্য ব্রিটেনের শরণাপন্ন হয়। দেড়শ বছর পূর্বে বেলজিয়াম ও ব্রিটেনের মধ্যেও চুক্তি হয়েছিল যেখানে ব্রিটেন বেলজিয়ামকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ব্রিটেন অবশ্য এ চুক্তি চাইলেই বাতিল করতে পারত। কিন্তু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হার্ভার্ড ভাবে যদি জার্মান বেলজিয়াম ও ফ্রান্স দখল করে নেয় তবে তারা ব্রিটেনকেও আক্রমণ করতে পারে। তাই প্রথমেই সৈন্যদের মনোবল ভেঙে দেয়া উচিত। ফলে ৪ আগস্ট জার্মান সৈন্যরা বেলজিয়ামে ঢুকে পরলে ব্রিটেন জার্মানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
খেয়াল করুন ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং ব্রিটেনও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ফেলেছে। আর ব্রিটেন অংশগ্রহণ করা মানে ব্রিটেনের দখলকৃত সকল দেশের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ভারতবর্ষ, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিশর ইত্যাদি। এসব দেশ বিপুল সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ইউরোপে পাঠায়। যেমন শুধুমা ভারতবর্ষ থেকে ৪.৫ লক্ষ সৈন্যকে যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয়।
তারপর বিভিন্ন কারণে কিছু এলোপাথাড়ি যুদ্ধ ঘোষণা হয়। যেমন
- ৬ আগস্ট অস্ট্রো-হাঙ্গেরি রাশিয়ার সাথে,
- ৮ আগস্ট সার্বিয়ার বন্ধুরাষ্ট্র মন্টিনিগ্রো অস্ট্রো-হাঙ্গেরির সাথে,
- ৯ আগস্ট ফ্রান্স অস্ট্রো-হাঙ্গেরির সাথে,
- ১২ আগ্টি ব্রিটেন অস্ট্রো-হাঙ্গেরির সাথে,
মন্টিনিগ্রো জার্মানির সাথে,
- ২৩ আগস্ট জাপান জার্মানির সাথে এবং
- ২৫ আগস্ট অস্ট্রো-হাঙ্গেরি জাপানের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
অর্থাৎ পৃথিবীর ৯টি দেশ একে অপরের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ব্রিটেনের অধীনস্ত দেশ হিসাব করলে পৃথিবীর ২৮টি দেশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
তুরস্ক পূর্বে অটোম্যান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। তুরস্কের জলসীমা ব্যবহার করে জার্মান নৌবাহিনী রাশিয়া আক্রমণ করলে রাশিয়া ৩ নভেম্বর, ১৯১৪ সালে অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
ইতালি জার্মানির মিত্র রাজ্য এবং মৈত্রী জোটের সদস্য। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে ইতালিকে জার্মানির সমর্থন দিতে হতো। কিন্তু ইতালি প্রথমদিকে যুদ্ধে অংশ নেয়নি। ২৬ এপ্রিল ১৯১৫ ইতালি লন্ডনে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে একটি গোপন বৈঠক করে। বৈঠকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইতালিকে মিত্র শক্তির পক্ষ থেকে যুদ্ধ করার প্রস্তাব দেয়। বিনিময়ে ইতালিকে তার সামনের কিছুটা অংশ অধিকার করতে দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতিও দেয়। এতে ৩ মে ইতালি মৈত্রি জোট থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় এবং ২৩ মে ইতালি অস্ট্রো-হাঙ্গেরির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
এবার আমেরিকাকে নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমেরিকার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার পেছনে কোন কারণ ছিল না। তবে জার্মানি আমেরিকাকেও টেনে নিয়ে আসে। কীভাবে?
পূর্বেই বলেছি তখন সমুদ্রে কেবল ব্রিটেন আর জার্মানরাই রাজত্ব করত। ব্রিটেনের সাথে জার্মানের যুদ্ধ ঘোষণার পর জার্মান ব্রিটেনের কোন জাহাজ বা জলযান দেখলেই আক্রমণ করে তা ডুবিয়ে দিত। এভাবেই এক যাত্রীবাহী জাহাজ ডুবানোর পর জানা যায় সেখানে দেড়শর বেশি আমেরিকান যাত্রী ছিল। এতে আমেরিকা জার্মানের সাথে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়। তবে জার্মান সম্রাট কাইজার এ বিষয়টিকে ভুল বলে আমেরিকার কাছে ক্ষমা চেয়ে পত্র পাঠায় এবং আশ্বাস দেন ভবিষ্যতে আক্রমণ করার পূর্বে তারা যাচাই করে নেবে সেখানে কোন আমেরিকান আছে কি না। এতে আমেরিকা সেবারের মতো শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু সমস্যা বাড়ে জামার্নির। জার্মান সৈন্যদের যাচাইকরণের সময় ব্রিটিশ সৈন্যরা আক্রমণ করে জার্মানদের জলযান ডুবিয়ে দেয়। এই সমস্যা সমাধান করতে কাইজার চাতুরির আশ্রয় নেয়। তিনি আমেরিকাতে গৃহযুদ্ধ লাগানোর চক্রান্ত করে।
আমেরিকা ১৮৪৮ সালে মেক্সিকোর ১৩ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের একটি অঙ্গরাজ্য দখল করে নিয়েছিল। সম্রাট কাইজার মেক্সিকোকে সেই অঙ্গরাজ্যটি পাইয়ে দিতে প্রতিজ্ঞা করেন এবং মেক্সিকোর প্রধানকে একটি গোপন কোড পাঠায়। দুর্ভাগ্যক্রমে এটি ব্রিটেনের এক গোয়েন্দা জেনে ফেলে এবং আমেরিকার কাছে ফাঁস করে দেয়। আমেরিকা জার্মানির এই চক্রান্ত বুঝতে পারে এবং ৬ এপ্রিল ১৯১৭ সালে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে কিউবা, পানামা, থাইল্যান্ড, গ্রিস, ব্রাজিল, হাইতি ইত্যাদি দেশও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে।
এভাবেই অস্ট্রো-হাঙ্গেরি এবং সার্বিয়ার মধ্যকার যুদ্ধ মহাযুদ্ধে পরিণত হয়।