ফার্ডিন্যান্ডের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার মধ্যকার যুদ্ধ শুরু হয়। কীভাবে এ যুদ্ধে বিভিন্ন দেশ জড়িয়ে পড়ে এবং তা মহাযুদ্ধের রুপ নেয় এখন আমরা তা জানব।
মহাযুদ্ধের কারণ জানতে চাইলে আমাদের ফিরে যেতে হবে কিছুকাল পূর্বে এবং বুঝতে হবে কিছু জটিল রাজনৈতিক বিষয়। যার মধ্যে বিভিন্ন ধরণের চুক্তি, আধুনিক মরণাস্ত্র, উগ্র জাতীয়তাবাদ, বলকান অঞ্চলসমূহ দখল করার মানসিকতা ইত্যাদি অন্যতম।
বিভিন্ন ধরণের চুক্তি
সে সময়কার ইউরোপের রাজনীতি ছিল অত্যন্ত জটিল ও গোপনীয়তায় ভরা। ফলে কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে অথবা নিছক সন্দেহের বশে বিভিন্ন দেশের সাথে বিভিন্ন দেশের নানা রকম চুক্তি হতে থাকে। একে অপরের সাথে জোট বাধতে থাকে।
Tripple Alliance বা মৈত্রী জোট
১৮৭৯ সালে জার্মানি ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে দ্বৈত জোট গঠন করে। ১৮৮২ সালে ইতালি এ জোটে যোগ দিলে এই ত্রিশক্তির জোটকে মৈত্রী জোট নামকরণ করা হয়।
মৈত্রী জোটের বিরুদ্ধে লড়াই করা ফ্রান্সের একার পক্ষে কঠিন। তাই ফ্রান্সও নিজের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে।
Tripple Entente বা মৈত্রী আতাঁত
বর্তমান রাশিয়া ১৭২১-১৯১৭ খ্রি. পর্যন্ত রাশিয়ান সাম্রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। রাশিয়ান সম্রাটদের বলা হতো জার। ১৯০৭ সালে ফ্রান্স রাশিয়ান সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে সন্ধি করে মৈত্রী আতাতঁ গঠন করে।
জার্মানির ব্রিটেনের সাথে সম্পর্ক প্রথমদিকে ভালই ছিল। ব্রিটেন নৌশক্তিতে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। তখনকার সদ্য আবিষ্কৃত সাবমেরিনের সাহায্যে ব্রিটিশরা সমুদ্রে রাজ করত। জার্মানি ব্রিটেনের সাথে পাল্লা দিয়ে সমুদ্রে রাজ করার কথা চিন্তা করলে সম্পর্কটি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে যায়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে সম্পর্কটি খারাপ হতে থাকে।
১৮৭৮ সালে উসমানীয় বা অটোম্যান সাম্রাজ্যের সাথে ব্রিটেনের সম্পর্ক খারাপ হলে জার্মানি অটোম্যান সাম্রাজ্যের সাথে মিত্রতা করে। সম্রাট দ্বিতীয় উইলিয়াম কাইজার বার্লিন থেকে বাগদাদ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করেন। এতে ব্রিটেনের উপনিবেশ ভারতবর্ষে জার্মানির দৃষ্টি রাখা অনেক সহজ হয়ে যায়। অর্থাৎ উপনিবেশগুলোও শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের পরস্পরের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার একটি কারণ ছিল।
ইউরোপের এরুপ আরও অনেক দেশ নানা রকম চুক্তির মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যুক্ত ছিল। বিভিন্ন কারণে এক রাষ্ট্রের সাথে অপর রাষ্ট্রের শত্রুতাও হতে থাকে। ফলে সমগ্র ইউরোপ মূলত দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ১ম বিশ্বযুদ্ধে মৈত্রী জোট ও মৈত্রী আতাঁত চুক্তি দুটিই মুখ্য ছিল। অন্যান্য চুক্তিসমূহ গৌণ ছিল।
এসব চুক্তির মধ্যে এমন বিষয় উল্লেখ ছিল যে, মিত্র রাজ্যসমূহ প্রয়োজন পরলে পরস্পরকে সামরিক শক্তির মাধ্যমে সহযোগিতা করবে। অর্থাৎ যদি কোন এক রাজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পরে তবে তার মিত্র রাজ্যসমূহ তাকে সাহায্য করার লক্ষ্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। এতে একে একে সকল দেশের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাই ছিল স্বাভাবিক। অর্থাৎ এসব চুক্তিই সাধারণ যুদ্ধকে মহাযুদ্ধে রুপান্তরিত করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
আধুনিক মরণাস্ত্র
বিশ্ব ইতিহাসে ১ম বিশ্বযুদ্ধই প্রথম ছিল যেখানে যুদ্ধবিমান ব্যবহার করা হয়েছিল। যুদ্ধবিমানের সাহায্যে আকাশপথে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল যা এর পূর্বে কল্পনাতীত ছিল।
বিংশ শতাব্দীর পূর্বে মরণাস্ত্রসমূহও ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। বন্দুকগুলিতে একবার ট্রিগার চাপলে কেবল একটি গুলি বের হতো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মরণাস্ত্রের ব্যাপক উন্নতি হয়। মেশিনগান, শক্তিশালী ট্যাংক, যুদ্ধবিমান আবিষ্কার হয়। মেশিনগানগুলি এমন ছিল যে মিনিটে ৬০০ টির মতো গুলি ছুড়তে পারত। ট্যাংকগুলি দ্বারা অনেক দূরে লক্ষ্যভেদ করা যেত। তবে এসব আধুনিক অস্ত্র জার্মান, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সেরই বেশি ছিল।
অধিকন্তু জার্মান ও ব্রিটেনের জলপথে যুদ্ধ করার জন্য ছিল সাবমেরিন। যা অন্য কোনো দেশের ছিল না।
এসব মরণাস্ত্রের সাহায্যে অল্প সময়ের মধ্যেই যেকোনো দেশ দখল করা সম্ভব ছিল। ফলে সৈনিকরা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উৎসাহ পেত। রাষ্ট্রপ্রধানরাও যেকোন সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না করে শক্তি প্রদর্শন করে সমাধান করাটাকে গৌরবের মনে করত। এরুপ উগ্র মন মানসিকতা মহাযুদ্ধকে আরও তরান্বিত করে।
বলকান অঞ্চলসমূহ দখল করার মানসিকতা
তুর্কি শব্দ বলকান অর্থ পর্বত। বলকান পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের প্রায় সবগুলো দেশই বলকান রাষ্ট্র নামে পরিচিত। যেমন সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া ইত্যাদি। এসব দেশসমূহ খনিজসম্পদে ভরপুর ছিল। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ছোট এসব দেশের সামরিক শক্তি বলতে তেমন কিছু ছিল না। ফলে শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের লোভাতুর দৃষ্টি ছিল এসব অঞ্চলে। এ নিয়েও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিবাদ ছিল। যা যুদ্ধের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়।
এতক্ষণের আলোচনায় এটি স্পষ্ট যে মহাযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার বীজ বিভিন্ন কারণে বহু বছর পূর্বেই রুপিত হয়েছিল। ধীরে ধীরে তা বাস্তবে পরিণত হতে যাচ্ছিল যা ফার্ডিন্যান্ড এর হত্যাকান্ডের মাধ্যমে চুড়ান্ত রুপ ধারণ করে।