আমরা জানি পৃথিবী সৌরজগতের ক্ষুদ্র একটু অংশ। এটি অনবরত সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এই সৌরজগৎ কার অংশ? সৌরজগৎ কাকে প্রদক্ষিণ করছে? তার নাম কী? তার গঠন কেমন?
এরূপ অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর মেলে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ সম্পর্কে জানলে। তাই আগ্রহীদের এসব জিজ্ঞাসার সমাধান দিতে আমাদের আজকের নিবেদন ‘আকাশগঙ্গা ছায়াপথ’।
…….
ছায়াপথ কী?
সূর্য একটি নক্ষত্র। এরুপ ১০ মিলিয়ন থেকে ১ ট্রিলিয়ন নক্ষত্র একটি সাধারণ মহাকর্ষীয় কেন্দ্রের চারদিকে ঘূর্ণায়মান থাকে। সেই ব্যবস্থাটি গঠিত হয় অগণিত সংখ্যক তারা, আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস ও ধূলিকণা, প্লাজমা এবং প্রচুর পরিমাণে অদৃশ্য বস্তু নিয়ে। মহাকর্ষীয় শক্তি দ্বারা আবদ্ধ মহাজাগতিক এই সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাকে বলা হয় ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি।
ছায়াপথ বিভিন্ন আকৃতির হতে পারে। যেমন উপবৃত্তাকার, কুন্ডলাকার, সর্পিলাকার ইত্যাদি। এর অভ্যন্তরে থাকে অতিবৃহৎ ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। সকল মহাজাগতিক বস্তুসমূহ এই কেন্দ্রকে আবর্তন করে ঘুরতে থাকে। বর্তমান বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দৃশ্যমান মহাবিশ্বে দুইশ বিলিয়নেরও বেশি ছায়াপথের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। বেশির ভাগ ছায়াপথের ব্যাস কয়েকশ আলোকবর্ষ থেকে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ এবং পাশাপাশি দুটি ছায়াপথের মধ্যবর্তী দুরত্ব কয়েক মিলিয়ন আলোকবর্ষ পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত কয়েকটি ছায়াপথ একত্রে লোকাল গ্রুপ অফ গ্যালাক্সি গঠন করে মহাকাশে অবস্থান করে।
আমরা ছায়াপথ কী ও তার গঠন কেমন তা জানলাম। এবার চলুন
ছায়াপথ আবিষ্কারের ইতিহাসটি জেনে নেই।
সর্বপ্রথম পারস্যদেশীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী আল সুফি কুণ্ডলাকার ছায়াপথের বর্ণনা করেন। তার বর্ণনাটি ছিল এন্ড্রোমিডা ছায়াপথের। ১৬১০ সালে গ্যালিলিও লক্ষ করেন ছায়াপথ অসংখ্য তারার সমন্বয়ে গঠিত। তবে ছায়াপথ সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য দিয়েছিলেন ইমানুয়েল কান্ট। তার প্রস্তাব অনুযায়ী ছায়াপথসমূহ অনেকটা সৌরজগতের মতোই। তবে অসংখ্য তারার সমন্বয়ে গঠিত ছায়াপথের পরিসর অনেক বড়। এখানেও মহাকর্ষীয় বস্তুসমূহ মহাকর্ষ বলের দ্বারা আবদ্ধ থাকে।
১৭৮০ সালে ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী চার্লস মেসিয়ার মহাজাগতীয় বস্তুসমূহের একটি তালিকা প্রণয়ন করেন। মেসিয়ারের তালিকায় ৩২ টি ছায়পথ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে তিনি প্রকৃতপক্ষে ১০৯ টি উজ্জ্বলতম নীহারিকার তালিকা করেছিলেন। ছায়াপথ ও নিহারীকার মধ্যে পার্থক্য জানা না থাকায় সেগুলো আলাদা করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে উইলিয়াম হার্শেল মেসিয়ারের তালিকাটি পরিবর্ধন করে সংখ্যাটি ৫০০০ এ নিয়ে যান। সেই তালিকায় অনেকগুলো ছায়াপথ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এখন আমরা জানব আমাদের সৌরজগতের অবস্থান সম্পর্কে।
আকাশগঙ্গা ছায়াপথ
আমাদের সৌরজগতের অবস্থান আকাশগঙ্গা বা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে। গ্রিক পুরাণ অনুসারে এই ছায়াপথের নামকরণ করা হয়েছে। প্রাচীনকালে মহাবিশ্ব বলতে এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথকেই বুঝানো হতো। কিন্তু মহাবিশ্বের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি মহাবিশ্বের অগণিত ছায়াপথের মধ্যে আকাশগঙ্গা একটি।
আকাশগঙ্গা ছায়াপথের সূচনা হয় প্রায় ১৩.৬ বিলিয়ন বছর আগে। সর্বপ্রথম ১৭৮৫ সালে ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম হার্শেল আকাশগঙ্গা ছায়াপথের আকৃতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এজন্য তিনি আকাশের বিভিন্ন অঞ্চলে দৃশ্যমান তারার সংখ্যা গণনা করেছিলেন। এটি অনেকটা সমতল ডিস্কের মতো। এর চারদিকে গোলাকৃতির আকটি আবরণ আছে যাকে ‘স্টোলার হালো’ বলে। আকাশগঙ্গার ব্যাস আনুমানিক ১ লক্ষ আলোকবর্ষ এবং পুরুত্ব প্রায় ১০০০ আলোকবর্ষ। স্টোলার হালোসহ ব্যাস ১ লক্ষ ৩০ হাজার আলোক বর্ষ। ছায়াপথটি পৃথিবী থেকে খালি চোখেও দেখা যায়। চাঁদ না উঠলে আকাশের দিকে অসংখ্য তারার যে সমাহার দেখা যায়, তাই আসলে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। খোলা চোখে এর কেবল ১.২% দেখা যায়। আকাশগঙ্গা ছায়াপথের বেশিরভাগ অংশ ৯০% ডার্ক মেটার দিয়ে তৈরি।
এটি সর্পিলাকার ছায়াপথ। এর ছয়টি বাহু আছে। আমাদের সৌরজগতের অবস্থান ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে ২৭,০০০ আলোকবর্ষ দূরে কালপুরুষ বাহুতে। স্পষ্টতই সৌরজগৎ আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ক্ষুদ্র একটু অংশ। ধারণা করা হয় ছায়াপথটিতে এরুপ ১০০-৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র থাকতে পারে। সূর্যের কাছাকাছি অবস্থিত অন্যান্য নক্ষত্রগুলো হচ্ছে:
আলফা সেন্টরাই, ভেগা, আর্কটুরাস (Alpha Centauri, Altair, Vega, Fomalhaut ও Arcturus) ইত্যাদি।
প্রাচীনতম নক্ষত্রের মধ্যে রয়েছে HE15230901। এর বয়স ১৩.২ বিলিয়ন বছর।
অন্যান্য ছায়াপথের মতো আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রেও একটি সুপারমেসিভ ব্ল্যাক হোল রয়েছে। তার নাম ‘সাজিটারিস-এ’। ব্ল্যাক হোলটির ব্যাস ৪ কোটি ৪০ লক্ষ কিমি। কয়েকটি নক্ষত্র মিলে নক্ষত্রমন্ডলীয় মেঘ গঠন করে ছায়াপথের কেন্দ্রকে পরিক্রমা করে। আমাদের সূর্য প্রতি সেকেন্ডে ২৩০কিমি বেগে এই কেন্দ্রকে পরিক্রমা করছে। সূর্যের একবার পরিক্রমা সম্পন্ন করতে ২৩০ মিলিয়ন বছর সময় লাগে। যা গ্যালাক্টিক ইয়ার বা কসমিক ইয়ার নামে পরিচিত।
আকাশগঙ্গা ছায়াপথে ১০০ বিলিয়ন এর বেশি গ্রহ আছে; ৫৯ টি স্যাটেলাইট গ্যালাক্সি আছে; রয়েছে কৃষ্ণগহ্বরসহ আরও অসংখ্য মহাজাগতিক বস্তু। সব মিলিয়ে ছায়াপথটির ভর ১.৫ ট্রিলিয়ন সৌর ভরের সমান।
আকাশগঙ্গাসহ ছোট বড় মিলিয়ে কমপক্ষে ৫৪টি ছায়াপথ নিয়ে গঠিত হয়েছে লোকাল গ্রুপ অফ গ্যালাক্সি। আমাদের লোকাল গ্রুপে এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি সবচেয়ে বড়। এন্ড্রোমিডার পরই আকাশগঙ্গার অবস্থান। এটি আকাশগঙ্গার সবচেয়ে নিকটবর্তী গ্যালাক্সিও বটে। পৃথিবী থেকে এর দৃরত্ব ২৫ লক্ষ আলোক বর্ষ। বিজ্ঞানীদের অনুমান আগামী ৪০০-৫০০ কোটি বছরের মধ্যে আমাদের মিল্কিওয়ে প্রতিবেশী এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির সাথে সংঘর্ষ করে নতুন একটি গ্যালাক্সিতে পরিণত হবে। কল্পিত এই নতুন গ্যালাক্সিটিকে মিল্কোমেডা বা মিল্কড্রোমেডা নাম দেয়া হয়েছে।
…….
আমাদের লোকাল গ্রুপ অফ গ্যালাক্সি ভির্গো সুপারক্লাস্টারের অংশ। ভির্গো সুপারক্লাস্টার আবার ল্যানিয়াকিয়া সুপারক্লাস্টারের অংশ। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আমাদের মহাবিশ্ব এর চেয়েও অনেক অনেক বড়। এই সুবিশাল মহাবিশ্ব কিভাবে উৎপন্ন হয়েছে? কখন উৎপন্ন হয়েছে? বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় এসব অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর জানতে আগ্রহীরা ‘বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব’ এই অনুচ্ছেদটি পড়তে পারেন।