মহাবিশ্ব গঠিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকার বস্তুর সমন্বয়ে। যার মধ্যে রয়েছে গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, নিহারীকা, ধূমকেতু, কৃষ্ণগহ্বর আরও কত কী! এসব মহাজাগতিক বস্তুসমূহের মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু হচ্ছে কৃষ্ণগহ্বর বা কৃষ্ণবিবর। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘ব্ল্যাক হোল’।
তো কেন ব্ল্যাক হোল মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তু তা ব্যাখ্যা করার জন্যই আমাদের আজকের নিবেদন ‘ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর’।
………..
ব্ল্যাক হোল কী ও তার গঠন
মহাবিশ্বকে একটি সমতল পৃষ্ঠের সাথে কল্পনা করা যাক। এখন এর যে কোন স্থানে একটি ভারী বস্তু রাখা হলে স্বভাবতই সেই স্থানটি একটু নিচে নেমে যাবে। একটি গর্তের সৃষ্টি হবে। ঠিক এই ব্যাপারটিই ঘটে মহাবিশ্বে। যে সব স্থানে অচিন্তনীয় বেশি ভর থাকে সেসব স্থানে স্থান-কাল বক্রতার সৃষ্টি হয়। পদার্থবিজ্ঞানের কোন সূত্রই সেই স্থানে কাজ করে না। সময় স্থির হয়ে যায়। অত্যাধিক ভরের কারণে সে স্থানের আকর্ষণ বলের মানও অনেক বেশি হয়। কোন কিছুই তার আকর্ষণ বল থেকে বের হয়ে যেতে পারে না। কোন মহাজাগতিক বস্তু যেমন নক্ষত্র সেই স্থানে প্রবেশ করলে তা আর বের হয়ে আসতে পারে না। মহাবিশ্বের এরুপ রহস্যময় সত্ত্বাকে বলা হয় ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর।
যে সীমানা অতিক্রম করলে ব্ল্যাক হোলের আকর্ষণ বল থেকে আর বের হয়ে আসা যায় না, তাকে বলা হয় ঘটনা দিগন্ত।
বাস্তবে ঘটনা দিগন্ত আমরা দেখতে পাইনা। কারণ সেখান থেকে তড়িতচৌম্বক বিকিরণ আলোও ফিরে আসতে পারে না। বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোলের চারপাশের বস্তুর প্রভাব দেখে ব্ল্যাক হোলের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হন।
ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। যা অসীম ঘনেত্বের অত্যন্ত ছোট একটি বিন্দু। কোন বস্তু ঘটনা দিগন্ত অতিক্রম করলে তা ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রে পতিত হয়।
ব্ল্যাক হোল আবিষ্কারের ইতিহাস
অসীম ভরবিশিষ্ট কোন বস্তু, যার আকর্ষণ বলের প্রভাব থেকে আলো পর্যন্ত মুক্তি পায় না এরকম সত্ত্বার ধারণা সর্বপ্রথম প্রদান করেন ভূতত্ত্ববিদ জন মাইকেল (John Michell)। ১৭৮৩ সালে এক চিঠিতে তিনি রয়েল সোসাইটির সদস্য এবং বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেন্ডিসকে (Henry Cavendish) এ সম্পর্কে জানান।
১৭৯৬ সালে গণিতবিদ পিয়েরে সিমন ল্যাপলেস তার বইয়ে একই মতবাদ উল্লেখ করেন। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের মতামত প্রকটভাবে উপেক্ষিত হয়। কারণ আলোর মতো ভরহীন তরঙ্গ কিভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে সেটা বোধগম্য ছিল না।
কিন্তু ১৯১৬ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্রের সাহায্যে জার্মান পদার্থবিদ কার্ল সোয়ার্টচাইল্ড প্রমাণ করেন যে, যেকোনো বস্তুই কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারে যদি তাকে যথেষ্ট সংকুচিত করা যায়।
যা হউক এ পর্যন্ত ব্ল্যাক হোল নিয়ে অল্প বিস্তর গবেষণা হলেও এর নামকরণ করা হয়নি। জন মাইকেল এ সত্ত্বাটিকে ডার্ক স্টার বলে উল্লেখ করেছিলেন। ব্ল্যাক হোল নামটি ব্যবহার করা হয় ১৯৬৭ সালে। পদার্থবিদ জন উইলার ‘ব্ল্যাক হোল’ নামকরণের প্রবর্তক।
কাগজে কলমে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব প্রমাণ করা গেলেও তা বাস্তবে পরিণত হয় ১৯৭১ সালে। কয়েকজন গবেষক স্বাধীনভাবে প্রথম ব্ল্যাক হোল আবিষ্কার করেন।
আর ১০ই এপ্রিল, ২০১৯; মানুষ সর্বপ্রথম ব্ল্যাক হোলের ছবি দেখতে পায়।
ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ দ্বারা এই ছবিটি তোলা হয়েছিল। ব্ল্যাক হোলটি মেসিয়ার 87 গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত।
ব্ল্যাক হোলের উৎপত্তি
এখন প্রশ্ন হচ্ছে মহাবিশ্বে এরুপ রহস্যময় সত্ত্বা কীভাবে সৃষ্টি হয়? আমরা জানি নক্ষত্রের নিজস্ব আলো আছে। নক্ষত্রের জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। কেন্দ্রমুখী সংকোচনধর্মী চাপ নক্ষত্রের আয়তন ছোট করতে থাকে। এ ঘটনা চলতে থাকলে নক্ষত্রটি অত্যাধিক ভরবিশিষ্ট অতি ক্ষুদ্র বস্তুতে পরিণত হয়। এ ক্ষুদ্র আয়তনের বস্তুটির আকর্ষণ বলের মান সাধারণ বস্তুর তুলনায় অনেক গুণ বেশি হয়। অর্থাৎ বস্তুটি পরিণত হয় এক মহাজাগতিক রাক্ষসে। কোন কিছুই তার আকর্ষণ বলের সীমানাকে অতিক্রম করতে পারে না। সবকিছুকেই সে নিজের দিকে টেনে নেয়। এভাবেই এক মৃত তারা পরিণত হয় মহাজাগতিক রাক্ষস ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরে।
ব্ল্যাক হোলের প্রকারভেদ
ব্ল্যাক হোল চার রকম হতে পারে। যথা:
- স্টেলার,
- ইন্টামিডিয়েট,
- সুপারমেসিভ এবং
- মিনিএচার ব্ল্যাক হোল।
এদের মধ্যে স্টেলার আর সুপারমেসিভ ব্ল্যাক হোলই বেশি দেখা যায়।
স্টেলার ব্ল্যাক হোল
সূর্যের চেয়ে ১০-২০ গুন বড় তারার মৃত্যু হলে স্টেলার ব্ল্যাক হোল উৎপন্ন হয়। আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথে ১ মিলিয়নের বেশি স্টেলার ব্ল্যাক হোল আছে।
সুপার মেসিভ ব্ল্যাক হোল
নাম থেকেই অনুমান করা যায় এ ধরণের ব্ল্যাক হোল দানব আকৃতির হবে। সুপার মেসিভ ব্ল্যাক হোল সূর্যের চেয়ে মিলিয়ন এমনকি বিলিয়ন গুণ বড়ও হতে পারে। প্রত্যেক ছায়াপথের কেন্দ্রে অন্তত একটি সুপার মেসিভ ব্ল্যাক হোল থাকে। আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রে যে সুপার মেসিভ ব্ল্যাক হোলটি আছে তার নাম ‘সাজিটেরিয়াস-এ’ । এটি সূর্যের চেয়ে ৪০ লক্ষ গুণ বেশি ভরযুক্ত। ছায়াপথের সমস্ত বস্তুই ব্ল্যাক হোলটিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথে ১০০ মিলিয়নের বেশি ব্ল্যাক হোল আছে। আর এই ছায়াপথেরই এক অতি নগণ্য অংশ আমাদের ‘সৌরজগৎ’।