আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি মহাবিশ্বে পৃথিবীর অবস্থান কোথায়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এই বৈচিত্র্যময় পৃথিবী তথা মহাবিশ্বের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছিল? মহাবিশ্ব এখন যেমন আছে পূর্বেও কি ঠিক তেমনি ছিল? অথবা ভবিষ্যতে মহাবিশ্বের কী হবে?
উৎসুক মনের এসব প্রশ্নের জবাব দিতে আমাদের আজকের নিবেদন বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ‘মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কিত বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব’।
……..
মহাবিশ্বের উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাব দিতে বেশ কয়েকটি নকশা প্রচলিত আছে। উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটি মডেল হচ্ছে বিগ ব্যাং তত্ত্ব, ফ্রেড হয়েলের স্থির অবস্থা নকশা তত্ত্ব, মাইন নকশা, রিচার্ড টলম্যান কর্তৃক প্রস্তাবিত কম্পনশীল মহাবিশ্ব, ফ্রিৎস জুইসি কর্তৃক প্রস্তাবিত দুর্বল আলো প্রকল্প ইত্যাদি। এসব তত্ত্বের মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, বিজ্ঞানসম্মত থিওরি হচ্ছে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব।
মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব অনুযায়ী,
সৃষ্টির আদিতে একটি অতি ক্ষুদ্র উত্তপ্ত বস্তু কণা ছিল। সব কিছু মানে সকল গ্রহ-নক্ষত্রসহ সকল শক্তি সেখানে কেন্দীভূত ছিল। ফলে কণাটি ছিল প্রায় অসীম ঘনত্বের। এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিছুই না মানে কিছুই না। না স্থান, না কাল। অতএব কেউ যদি প্রশ্ন করে তার পূর্বে কি ছিল বা তার চারপাশে কি ছিল? তবে সেই প্রশ্নটা অবান্তর। আনুমানিক ১৩৭৫ কোটি বছর আগে অসীম ঘনত্ব বিশিষ্ট সেই বস্তুকণাতে মহাবিস্ফোরণ হয়, আর সেখান থেকেই জন্ম হয় মহাবিশ্বের।
মহাবিস্ফোরণ থেকে জন্ম নেওয়া অসংখ্য বস্তুকণা একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। ফলে তাদের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান সৃষ্টি হয়েছিল। বস্তুকণাসমূহ পরস্পরের থেকে কত দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে তা ব্যাখ্যা করার জন্যই ‘সময়’ ধারণার প্রয়োজন হয়েছিল। অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের পূর্বে না তো কোন স্থান ছিল, না কোন সময়। স্থান-কাল সৃষ্টি এই মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে হয়েছিল। আইনস্টাইনও তার আপেক্ষিকতার থিওরিতে বলেছেন, স্থান-কাল আপেক্ষিক; চরম কিছু নয়। অতএব বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণই মহাবিশ্ব সৃষ্টির মূল কারণ।
মতবাদটি অযৌক্তিক মনে হতে পারে; পূর্বেও হয়েছিল। এমনকি বিতর্ক এখনও চলমান। তবে এখনও পর্যন্ত এটিই সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য মতবাদ।
এবার চলুন মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার পেছনের ইতিহাসটি জেনে নেই।
১৯২৭ সালে বেলজিয়ামের রোমান ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারক জর্জ ল্যামেথর সর্বপ্রথম বিগ ব্যাং শব্দটি ব্যবহার না করে প্রস্তাব করেন যে, মহাবিশ্ব একটি সুপ্রাচীন পরমাণু থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে, যে প্রস্তাব বর্তমানে মহাবিস্ফোরণ নামে পরিচিত। তার প্রস্তাব যুক্তিসংগত হলেও কেউ মেনে নেয়নি। কারণ যার তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে তিনি এই প্রস্তাব করেছিলেন সেই আইনস্টাইন নিজেই এটি মানেনি।
দুই বছর পর ১৯২৯ সালে মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন হাবল আবিষ্কার করেন যে, একটি ছায়াপথ পৃথিবী থেকে যত দূরে অবস্থিত তার পশ্চাদপসরণের বেগও তত বেশি। মানে নিঃসৃত আলোর বর্ণালি ততোই লাল তথা দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘে্য দিকে সরে যায়। এটিই হাবলের নীতি নামে পরিচিত। যা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে মহাবিশ্ব ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। এতে লেমেথের তত্ত্বটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা পায়।
অর্থাৎ জর্জ ল্যামেথর মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের প্রবর্তক হলেও এর প্রথম পরীক্ষামূলক প্রমাণ করেন এডুইন হাবল।
এর ফলে মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব ফ্রেড হয়েলের স্থির অবস্থা নকশা তত্ত্বকে ছাপিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থির অবস্থা নকশা তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্ব যখন সম্প্রসারিত হতে শুরু করে তখন এখানে নতুন পদার্থ সৃষ্টি হতে পারে। তবে সময়ের যে কোন বিন্দুতে মহাবিশ্ব একই রকম থাকে।
ফলে ফ্রেড হয়েল সাহেব তত্ত্বটির বিরোধিতা করেন। বিরোধিতা করলেও বিগ ব্যাং নামটি স্থির অবস্থা নকশা তত্ত্বের প্রবর্তক ফ্রেড হয়েলেরই দেওয়া। ১৯৪৯ সালের ২৮শে মার্চ বিবিসিতে প্রচারিত থার্ড প্রোগ্রামে তিনি শ্লেষের বশে তত্ত্বটিকে বিগ ব্যাং বলে উল্লেখ করেন। পরে কয়েকটি বক্তৃতায়ও তিনি শব্দটি ব্যবহার করেন এবং পত্রিকাতেও বিগ ব্যাং নামে তত্ত্বটিকে ছাপানো হয়। ফলে এটি বিগ ব্যাং নামেই প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায় যাকে মহাবিস্ফোরণ বলা যায়।
পরবর্তীতে জর্জ গ্যামো তার ছাত্র রলফ আলফার এর সাথে মিলে এই তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন এবং একটি জার্নালে ‘আলফা-বিটা-গামা পেপার’ শিরোনামে তার হিসাব প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, একটি মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে যদি মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে সেই ভয়ঙ্কর বিকিরণের কিছুটা স্বাক্ষর, মানে বিকিরণ-রেশের কিছুটা এখনও বজায় থাকার কথা। তার হিসাব অনুসারে, সৃষ্টির আদিতে যে তেজোময় বিকিরণের উদ্ভব হয়েছিল, মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে তার বর্ণালী তাপমাত্রা হ্রাস পেতে পেতে সেটা এখন পরম শূন্য তাপমাত্রার উপরে ৫ ডিগ্রি কেলভিনের মতো হওয়া উচিত। এই ব্যাপারটিই ধরা পড়ে ১৯৬৪ সালে আর্নো পেনজিয়াস আর রবার্ট উইলসনের পরীক্ষায়; গ্যামোর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হবার ১৬ বছর পর। এরপর থেকেই মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব মহাবিশ্ব সৃষ্টির সবচেয়ে উপযোগী তত্ত্ব রুপে স্বীকৃতি পায়।
মহাবিস্ফোরণের
- (১০−৪৩ সেকেন্ড) পর পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো কার্যকারিতা লাভ করে।
- পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রকার মূল কণিকা এবং
- প্রায় ৩ লক্ষ ৮০ হাজার বছর পর পরমাণুর উদ্ভব হয়।
- আরও পরে সৃষ্টি হয় তারা, ছায়াপথ (১ বিলিয়ন বছর) এবং অন্যান্য জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বা মহাজাগতিক বস্তুর।
যত সহজে বলা হচ্ছে বিষয়টি কিন্তু মোটেই ততটা সহজ ছিল না। এসব বিষয় বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে বিজ্ঞানীদের অনেক শ্রম ও সময় ব্যয় করতে হয়েছে।
যা হউক এক কথায় মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে। আর এটি গঠিত হয়েছে অসংখ্য মহাজাগতিক বস্তুর সমন্বয়ে।
মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ
মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুটি মতবাদ প্রচলিত আছে।
আমরা জানি হাবলের নীতি অনুযায়ী, মহাবিশ্ব ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। ১ম মতবাদ অনুসারে সম্প্রসারণ একসময় থেমে যাবে এবং মহাবিশ্ব আবার সংকুচিত হওয়া শুরু করবে। এতে মহাবিশ্ব আবার পূর্বের অবস্থায় মানে অসীম ঘনত্ববিশিষ্ট একটি বস্তুকণায় পরিণত হবে।
২য় মতবাদ অনুসারে, সম্প্রসারণ ধীর গতিতে হবে কিন্তু কখনই থেমে যাবে না।