সুপ্রাচীনকাল থেকেই উৎসুক মানব সমাজ মহাবিশ্বে পৃথিবীর অবস্থান জানতে চেষ্টা করেছিল। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণাও তারা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। টলেমির মতবাদ অনুসারে ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত মানুষের ধারণা ছিল পৃথিবী কেন্দ্র। বাকি সব গ্রহ নক্ষত্রগুলো পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। ষোড়শ শতাব্দীতে নিকোলাস কোপারনিকাস এ ধারণার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, সূর্য কেন্দ্র। পৃথিবীসহ বাকি সব গ্রহ উপগ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। পরবর্তীতে টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পর গ্যালিলিও কোপারনিকাসকে সমর্থন করেন। এজন্য তাকে কারবরণ করতে হয়েছিল। যা হউক এতো ছিল কেবল সৌরজগতের কথা। মহাবিশ্বের তুলনায় সৌরজগতকে তুলনাও করা যাবে না। সেক্ষেত্রে মহাবিশ্বে পৃথিবীর অবস্থান জানাটা সত্যিই রোমাঞ্চকর একটি ব্যাপার হবে।
সুবিশাল এই মহাবিশ্বে আমাদের তথা পৃথিবীর অবস্থান জানাতেই আমাদের আজকের নিবেদন ‘মহাবিশ্বের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা’।
……
(পৃথিবী)
পৃথিবী থেকেই শুরু করা যাক। এখানেই আমাদের ঘর। আমরা এখানে থাকি। চাঁদ নামে পৃথিবীর একটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ আছে। চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। আর পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে।
সৌরজগৎ
সূর্য একটি নক্ষত্র। এর নিজ্বস্ব আলো আছে। পৃথিবীসহ ৮টি গ্রহ ও তাদের উপগ্রহসমূহ, বামন গ্রহ এবং অসংখ্য ক্ষুদ্র বস্তু নিয়ে গঠিত হয়েছে সূর্যের জগত। এসব মহাজাগতীয় বস্তুসমূহ সূর্যের আকর্ষণ বলের কারণে সুনির্দিষ্ট শৃঙ্খলে যুক্ত রয়েছে। সূর্য নামক নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এই ব্যবস্থাই সৌরজগত। পৃথিবী সৌরজগতের ক্ষুদ্র একটা অংশ।
নক্ষত্রমন্ডলীয় মেঘ বা লোকাল ইন্টারস্টেলার ক্লাউড
সুর্যসহ আরও কিছু নক্ষত্র যেমন আলফা সেন্টরাই, ভেগা, আর্কটুরাস (Alpha Centauri, Altair, Vega, Fomalhaut ও Arcturus)
ইত্যাদি মুটামুটি ৩০ আলোকবর্ষ জুড়ে ব্যাপ্ত এক নক্ষত্রমন্ডলীয় মেঘে পরিভ্রমণ করছে। একে বলা হয় লোকাল ইন্টারস্টেলার ক্লাউড বা নক্ষত্রমন্ডলীয় মেঘ।
উল্লেখ্য আলোকবর্ষ মানে হচ্ছে আলো এক বছরে যে পথ অতিক্রম করে তা। এক আলোকবর্ষ সমান সাড়ে নয় লক্ষ কোটি কিলোমিটার।
আকাশগঙ্গা বা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি
সূর্যের মতো ২০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন তারা এবং আরও অসংখ্য মহাজাগতিক বস্তু নিয়ে গঠিত হয়েছে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। এটিই হচ্ছে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। এটি একটি সর্পিলাকার ছায়াপথ। এর ব্যাস আনুমানিক এক লক্ষ আলোকবর্ষ এবং পুরুত্ব প্রায় এক হাজার আলোক বর্ষ। বিশাল এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ছয়টি সর্পিল বাহু আছে। কালপুরুষ বাহুতে আমাদের সৌরজগৎ এর অবস্থান। কেন্দ্র থেকে যার দুরত্ব ২৭,০০০ আলোকবর্ষ। স্পষ্টতই সৌরজগত আকাশগঙ্গা ছায়াপথের এক নগণ্য অংশ। অর্থাৎ এখান থেকে আমাদের পৃথিবী সম্পূর্ণরুপে অদৃশ্য।
পূর্বে মনে করা হতো এখানেই মহাবিশ্বের শেষ। কিন্তু বর্তমান তথ্য অনুযায়ী মহাবিশ্বের বিশালতা কেবল শুরু।
লোকাল গ্রুপ অফ গ্যালাক্সি
ছবিতে দেখুন আকাশগঙ্গা ছায়াপথের নিকটবর্তী ছায়াপথ হচ্ছে এন্ডোমিডা ছায়াপথ। এরুপ কমপক্ষে ৫৪টি ছায়াপথ নিয়ে গঠিত জোটকে লোকাল গ্রুপ অফ গ্যালাক্সি বলা হয়। আমাদের লোকাল গ্রুপ অফ গ্যালাক্সির মধ্যে প্রধান তিনটি গ্যালাক্সি হচ্ছে এন্ড্রোমিডা, আকাশগঙ্গা এবং ট্রায়াঙ্গুলাম গ্যালাক্সি। বাকি গুলো অপেক্ষাকৃত কম উজ্জ্বলতর এবং ছোট আকৃতির বামন ছায়াপথ।
ভির্গো ক্লাস্টার
এরুপ কমপক্ষে একশত লোকাল গ্রুপ এবং ক্লাস্টার মিলে গঠিত হয়েছে ভির্গো ক্লাস্টার। এর ব্যাস আনুমানিক ১১০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ। ভির্গো ক্লাস্টারের প্রান্তের দিকে অবস্থান করছে আমাদের লোকাল গ্রুপ অফ গ্যালাক্সি।
ল্যানিয়াকিয়া সুপারক্লাস্টার
ভির্গো ক্লাস্টারের মতো আরও কয়েকটি সুপারক্লাস্টার পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যে বিশাল আকৃতি গঠন করেছে তাই ল্যানিয়াকিয়া সুপারক্লাস্টার। এতে মোটামুটি ৩০০ থেকে ৫০০ গ্যালাক্সি গ্রুপ ও ক্লাস্টার রয়েছে।
অবজারভেবল ইউনিভার্স
আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব গঠিত হয়েছে এরুপ মিলিয়ন সংখ্যক সুপারক্লাস্টার, গ্যালাক্টিক ফিলামেন্ট ও শুন্যস্থান নিয়ে। এর ব্যাস ৯১ বিলিয়ন আলোক বর্ষ। দৃশ্যমান মহাবিশ্বে কমপক্ষে দুই ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ রয়েছে। মহাবিশ্ব সর্বত্র প্রতিসম ধরে নিলে পর্যক্ষেণযোগ্য মহাবিশ্বের সীমানা সকল দিক থেকে সমান হবে। অর্থাৎ আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব হবে গোলাকৃতির। এটিই এখনও পর্যন্ত জানা আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব।
মহাবিশ্বের এই বর্ণনা বিজ্ঞানীদের ৪০০ বছরের টেলিস্কোপিক পর্যবেক্ষণের ফসল।
ইউনিভার্স
তবে ধারণা করা হয় যে, এর বাইরে আরও অনেক কিছু আছে। কারণ আমরা কেবল সেসব কিছুর তথ্যই পেতে পারি যা থেকে আলো এসে আমাদের পৃথিবীতে পৌঁছায়। দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বাইরের অংশ থেকে আলো আমাদের পৃথিবীতে আসলে হয়ত আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরও অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেতাম।
যা হউক এই হচ্ছে আমাদের মহাবিশ্ব।
এক নজরে দেখলে মহাবিশ্ব; দৃশ্যমান মহাবিশ্ব; ল্যানিয়াকিয়া সুপারক্লাস্টার; ভির্গো সুপারক্লাস্টার; লোকাল গ্রুপ অফ গ্যালাক্সি; মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি; লোকাল ইন্টারস্টেলার ক্লাউড; সৌরজগৎ; পৃথিবী। আর এই পৃথিবীর ক্ষুদ্র এক জীব মানুষ। মহাবিশ্বের তুলনায় কত ক্ষুদ্র অংশে আমরা আছি। সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার!
……
এবার ভাবুন, পৃথিবী তো ছাড় যদি কোন কারণ ছাড়াই সৌরজগৎ মহাবিশ্ব থেকে উধাও হয়ে যায়; তবে তা মহাবিশ্বের উপর কোন প্রভাবই পড়বে না। তবুও, এত জটিলতার মধ্যে, পৃথিবী যুগ যুগ ধরে টিকে আছে স্বমহিমায়। আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। এটা কেবল আশ্চর্যের নয়; আনন্দের সংবাদও বটে। অথচ পৃথিবীর একজন সাধারণ মানুষ হয়ে আমরা কেবল আমাদের দিক বিবেচনা করেই নিশ্চিত করি আজকের দিনটা ভালো কি মন্দ! মহাবিশ্বের বিশালতা উপেক্ষা করে নিজেকে প্রাধান্য দেওয়া; এটা কি হাস্যকর নয়!!! মহাবিশ্বের তুলনায় যেখানে পৃথিবীই কোন কিছু নয়; যে কোন সময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে সেখানে আমাদের বেঁচে থাকাটাই কি অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় নয়!
অবশ্যই বিবেচনা করবেন।