আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি আগুনের ব্যবহার মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি করে। ফলে মানুষ জীবজগতের একমাত্র প্রাণী হিসেবে জটিল চিন্তা তথা কল্পনা করার ক্ষমতা লাভ করে। আবিষ্কার করে ভাষা।
এই পর্বে আমরা দেখব কীভাবে এই কল্পনাশক্তি ও ভাষার জোড়ে মানুষ সংস্কৃতি গড়ে তোলে। জীবজগতের অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা হয়ে জীবজগতের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তবে চলুন শুরু করা যাক “আদিম মানব সমাজ”।
সংস্কৃতি গড়ে উঠার কারণ (বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব)
জীবজগতের বেশিরভাগ প্রাণীই দলবদ্ধ থাকতে পছন্দ করে। জীবন ধারণের জন্য এই কৌশল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দলবদ্ধভাবে অনেক কঠিন কাজও সহজে সম্পন্ন করা যায়। অসম্ভব মনে হওয়া কাজও করে ফেলা যায়। সূচনালগ্ন থেকেই অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে দলবদ্ধভাবে থাকত।
প্রথমদিককার মানুষেরা দলবদ্ধভাবে বড় বড় প্রাণী শিকার করত। এজন্য তারা ব্যবহার করত শক্ত লাঠি ও ধারালো পাথর। ধারালো পাথরকে লাঠির মাথায় বসিয়ে তারা তৈরি করতো বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র। তারপর সেই অস্ত্র দিয়ে বিভিন্ন প্রকার শব্দ তৈরি করে একে অপরকে সাহায্য করে শিকার করত। সময়ের সাথে সাথে তারা আগুনের জাদুকরী ব্যবহারের কথা জানতে পারে। শিকারে নতুন অস্ত্র যোগ হয় আগুন।
তাছাড়া আগুনকে মাংস সিদ্ধ করার কাজে ব্যবহার করা হয়। কারণ সিদ্ধ মাংস তুলনামূলক নরম ও সুস্বাদু হয়। এতে কম চিবিয়ে খাওয়া যায়। চোয়ালের আকার হ্রাস পায়। পরিপাকে কম শক্তি ব্যয় হয়। মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি পায়।
বড় মস্তিষ্ক মানে বেশি চিন্তা, বেশি বুদ্ধি। মানুষের আচার-আচরণে তার প্রভাব পরে।
জটিল চিন্তা উন্নত হাতিয়ার তৈরি করে শিকার সহজতর করে।
বৈচিত্র্যময় শব্দ তৈরি করে বিভিন্ন অনুভূতি বোঝানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। স্বরযন্ত্র ধীরে ধীরে গলার মাঝখানে চলে আসে। বৈচিত্র্যময় শব্দ সৃষ্টি হয়। জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মস্তিষ্কের নিউরনগুলো বিকশিত হয়। শব্দ আরও জটিল হয়। শব্দগুলোকে অর্থপূর্ণ করতে মস্তিষ্ক আরও উন্নত হয়। সৃষ্টি হয় ভাষা। ভাবের আদান- প্রদান সহজতর হয়।
মানুষ আরও বেশি নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা অন্যকে বুঝাতে শেখে।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই বুদ্ধির প্রভাব পরে, ব্যাপক পরিবর্তন হয়। শুরু হয় নতুন এক অধ্যায়। বিজ্ঞানীরা একেই ‘বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব’ নামে অভিহিত করেছেন।
আনুমানিক ৭০ হাজার বছর পূর্বে এই বিপ্লব শুরু হয়। মানব ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম বিপ্লব যার ফলে মানুষের জীবনযাত্রা অন্য প্রাণী থেকে আলাদা হতে থাকে। যাকে আমরা বলি ‘সংস্কৃতি’।
সংস্কৃতি
অর্থাৎ, কোন একটি প্রজাতির ব্যবহৃত সব বাস্তব উপকরণ, খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক-পরিচ্ছেদ, ভাষা, উৎপাদন পদ্ধতি এবং আচার-আচরণকে একসাথে বলা হয় সংস্কৃতি।
কেন কেবল মানুষই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পেরেছে?
সংঘবদ্ধতা, আগুনের ব্যবহার, বড় মস্তিষ্ক, ভাষা ইত্যাদি আবিষ্কার কেবল মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই মানুষই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পেরেছিল। অন্য কোনো প্রাণী মানুষের মতো জটিল চিন্তা করার জন্য সমর্থ নয়। মানুষ তার বুদ্ধি দিয়ে এসব আবিষ্কারকে দিন দিন আরও সমৃদ্ধ করছিল। ফলে অন্য প্রাণীর সাথে মানুষের প্রভেদও সময়ের সাথে সাথে বাড়ছিল।
শিকারী বা বন্য সমাজ
৭০ হাজার বছর পূর্বে বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই মানুষ শিকার করে খেত। ১২ হাজার বছর পূর্বে তারা কৃষিকাজ করতে শেখে। মাঝখানের এই সময়টাতে শিকারী মানব সমাজ তথা বন্য সমাজের সংস্কৃতি ছিল বর্তমান সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে বংশ পরম্পরায় তাদের মধ্যে কিছু গুণ চলে এসেছিল। যেমন তারা অস্ত্রের ব্যবহার জানত, আগুনের ব্যবহার জানত, একটু-আধটু ভাবের বিনিময় করতে পারত। বাকি বৈশিষ্ট্যগুলো বুদ্ধির সহায়তায় ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। চলুন সেই শিকারী সমাজের জীবনযাত্রা তথা সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনে নেই।
বাসস্থান
বন্য মানুষ শিকার করে ও ফলমূল সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করত। শিকারের জন্য তাদের বন্যপ্রাণীর উপর নির্ভর করতে হতো। বন্য প্রাণীর খোঁজে বা বন্য প্রাণীর দলকে অনুসরণ করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াতে হতো। কোনো স্থানে ফলমূল শেষ হয়ে গেলে সেই স্থান পরিবর্তন করতে হতো। অর্থাৎ তারা ছিল যাযাবর প্রকৃতির। কোন স্থায়ী আবাস ছিল না।
প্রথমদিকে বন্য মানুষ খোলা যায়গায় থাকত। পর্যায়ক্রমে শীত ও বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে তারা গুহাবাসী হয়। আগুন দিয়ে গুহার প্রাণীকে তাড়িয়ে তারা গুহা দখল করত।
যেসব যায়গায় গুহা ছিল না সেখানে তারা তাঁবু বানিয়ে থাকত। এমনকি শিকারী মানুষদের গর্ত খুরে থাকারও প্রমাণ পাওয়া যায়।
সামাজিক কাঠামো
বন্য সমাজে নারী-পুরুষে কোনো প্রভেদ ছিল না। তারা দলবদ্ধভাবে থাকত। তাদের কোনো পরিবার ছিল না। সকলে একসাথে থাকত। মোটামুটি ৫০ জনের কাছাকাছি একটা দল গঠন করে তারা থাকত। বয়স ও লিঙ্গের ভিত্তিতে তাদের কাজ নির্ধারিত হতো। সাধারণত পুরুষেরা শিকারে যেত আর নারীরা ফলমূল সংগ্রহ করত। তবে প্রয়োজন পরলে একে অপরকে সাহায্য করত। কড়াকড়ি কোনো নিয়ম ছিল না।
কখনও কখনও তারা গোষ্ঠীর মধ্য থেকে একজনকে বিশেষ কাজে সল্প সময়ের জন্য নেতা নির্বাচিত করত। তবে নেতাদের কোনো বিশেষ সুবিধা ছিল না।
খাদ্যাভ্যাস
বন্য মানুষেরা মিলেমিশে শিকার করত, ফলমূল সংগ্রহ করত। তারপর সবাই ভাগ করে নিত। যার যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু নিত। কোনো ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা ছিল না। খাবার সংরক্ষণ করে রাখার কৌশল জানা ছিল না। অর্থাৎ তারা ছিল অনেকটা ‘দিন আনি দিন খাই’ ধরণের।
চাষাবাদ ও পশুপালনে তাদের কোনো ঝোঁক ছিল না।
ভাবের আদান-প্রদান ও ভাষা
শিকারী-সংগ্রাহক সমাজের ভাষা ছিল সহজ, ব্যাবহারিক এবং ধ্বনি ও অঙ্গভঙ্গির মিশ্রণ। মূলত বিপদ থেকে রক্ষা, শিকার ও তথ্য আদান-প্রদানের জন্যই তারা ভাষা ব্যবহার করত। তাদের শব্দভান্ডার ছিল সীমিত। পরিস্থিতি অনুযায়ী এসব শব্দের অর্থ ভিন্ন ভিন্ন হতো।
অভিজ্ঞতা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তর ও গল্প বলার তাগিদে শব্দের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এতে ধীরে ধীরে তাদের ভাষা সমৃদ্ধ হতে থাকে।
প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম
শিকারী মানুষের প্রযুক্তি ছিল ধুবই সাধারণ। তারা পাথর, হাড় ও কাঠ দিয়ে তৈরি সরঞ্জাম ব্যবহার করত। শিকারের জন্য ব্যবহার করত বর্শা, তীর-ধনুক।
ধর্ম ও বিশ্বাস
শিকারী মানুষেরা প্রাকৃতিক শক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে তারা প্রাকৃতিক শক্তি ও প্রকৃতি তথা গাছ ও প্রাণীর পূজা করত। তারা স্বপ্ন সম্পর্কে কৌতুহলী ছিল। আত্মায় বিশ্বাসী ছিল। আর এসব বিশ্বাস থেকেই বৃদ্ধদের যত্ন নেওয়া, কবর দেওয়া, মৃত্যুর পর আচার-অনুষ্ঠান করা এসব রীতি চালু হয়।
শিল্প
শিকারীরা প্রাকৃতিক রং ও উপকরণ ব্যবহার করে গুহাচিত্র আকঁত। তাদের চিত্রসমূহের মধ্যে বেশিরভাগই হচ্ছে শিকারের কৌশলের চিত্র, বিভিন্ন প্রাণীর চিত্র, সামাজিক কার্যক্রমের চিত্র, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মিশ্রণে রহস্যময় চিত্র ইত্যাদি।
তারা হাড়, দাঁত, পাথর ইত্যাদি দিয়ে অলংকার তৈরি করত।
এসব গুহাচিত্র, অলংকার ও অন্যান্য শিল্পকর্মের মাধ্যমে শিকারীরা নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করত।
উপরিউক্ত বিষয়সমূহ থেকে আমরা প্রাচীন শিকারী সমাজ সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি। তখন মানুষ পাথর ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করেনি। তাই প্রাগৈতিহাসিক এ যুগকে পাথরের যুগ বা প্রস্তর যুগ বলা হয়।
উল্লেখ্য বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের সময় অর্থাৎ ৭০ হাজার বছর পূর্বে জলবায়ুর পরিবর্তন, খাদ্যের খোঁজ ও নতুন অঞ্চলে বসবাস করার তাগিদে মানুষ তাদের জন্মস্থান আফ্রিকা ছেড়ে বাইরে বের হয়। পর্যায়ক্রমে তারা মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা মহাদেশে পৌঁছায়। ফলে শিকারী সমাজের উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো কোনো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ছিল না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে থাকা বিভিন্ন শিকারী গোষ্ঠী এসব বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে লাভ করে। গোষ্ঠীভেদে বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে কিছু পার্থক্যও (বিশ্বাস, রীতি নীতি) থাকে। তবে মোটামুটি ৭০ হাজার বছর পূর্ব থেকে কৃষি বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত এসব বৈশিষ্ট্য শিকারী সমাজে দেখা যায়।
যা হউক সময়ের সাথে সাথে এসব ধারণা পরিবর্তিত হতে থাকে, উন্নততর হতে থাকে মানুষের সংস্কৃতি। ফলে এক সময় এই সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। মানুষ
- শিকার ছেড়ে কৃষিকাজ শেখে;
- যাযাবর থেকে গৃহবাসী হয়;
- গড়ে তোলে গ্রাম, নগর;
- শুরু হয় বাণিজ্য;
- তৈরি করে আইন;
- শিক্ষার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা তথা জ্ঞান বিনিময় করে।
সংস্কৃতির এরূপ উন্নততর অবস্থাকে আমরা বলি সভ্যতা। অর্থাৎ বন্য মানুষ ধীরে ধীরে সভ্য হতে থাকে। আগামী পর্বে আমরা শিকারী মানুষের সভ্য হওয়ার গল্প সম্পর্কে জানব।