কেমন ছিল পৃথিবীর প্রথম মানুষ

আদি মানব
আদি মানব

আজ থেকে আড়াই লক্ষ বছর আগের কথা। বর্তমান ৮০০ কোটির বেশি মানুষের পৃথিবীতে তখন কেবল আফ্রিকায় গুটি কয়েক মানুষ বসবাস করতো। এছাড়া বাকি পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকলেও তারা আমাদের প্রজাতির ছিল না। অর্থাৎ তাদের সাথে আমাদের বংশবৃদ্ধি সম্ভব ছিল না। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য। আর এর চেয়েও বড় সত্য হলো তাদের শারীরিক গঠন আমাদের মতো হলেও পশুদের সাথে তাদের কোনো প্রভেদ ছিল না। পশুদের মতোই ছিল তাদের জীবনযাত্রার ধরণ। প্রথম দিককার সেই মানুষদের সম্পর্কে জানতেই আমাদের আজকের নিবেদন “সৃষ্টির আদি মানব”।

 

প্রথমে চলুন মানুষ জাতি ও আধুনিক মানুষের মধ্যে প্রভেদটা বুঝে নেই।

জীববিজ্ঞানের ভাষায় যেসব প্রাণী পরস্পরের মধ্যে প্রজননের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম তাদেরকে একই প্রজাতির গণ্য করা হয়। যেমন বাঘ একটি প্রজাতি, গরু অন্য একটি প্রজাতি। আলাদা প্রজাতি হওয়ায় তারা নিজেদের মধ্যে বংশবৃদ্ধি করে সন্তান জন্ম দিতে পারবে না (ব্যতিক্রম আছে)। তবে বাঘ, গরু, সিংহ, কুকুর ইত্যাদি প্রাণীকে সাধারণভাবে আমরা পশু বলে থাকি।

যেসব প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ থেকে উৎপত্তি লাভ করে তাদের একই জাতি বা গণর অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়। যেমন বিবর্তন অনুযায়ী বাঘ ও সিংহ আলাদা প্রজাতি হলেও তারা একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে। একই প্রজাতির প্রাণী একদল বিবর্তিত হয়ে বাঘ ও একদল সিংহে পরিণত হয়েছে। সাধারণভাবে বলতে গেলে এই পূর্বপুরুষ প্রজাতিটিই হচ্ছে ‘গণ’। বাঘ ও সিংহের গণের নাম ‘প্যানথেরা’। এ কারণে বাঘ ও সিংহের মধ্যে অনেক মিল লক্ষ করা যায়।

ঠিক এরুপ মানুষ হচ্ছে গণ আর আমরা আধুনিক মানুষ হচ্ছি প্রজাতি। যেমনভাবে অনেক প্রকার পশু পৃথিবীতে বিদ্যমান; ঠিক তেমনিভাবে মানুষ গণের আরও অনেক প্রজাতি পৃথিবীতে ছিল। বর্তমানে সব প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আধুনিক মানুষ শুধু টিকেই আছে না; সদর্পে পৃথিবীতে রাজত্ব করছে।

বিজ্ঞানীদের অনুমান এই হোমো জেনাস বা মানুষ গণের জন্ম হয়েছিল আনুমানিক ২৫ লক্ষ বছর পূর্বে।

চলুন মানুষ গণের প্রাজাতিদের সাথে পরিচিত হয়ে নেই।

 

হোমো হেবিলিস বা হেন্ডি ম্যান

 

habilis
habilis

 

মানুষ গণের প্রথম প্রজাতি হচ্ছে “হোমো হেবিলিস”।

আনুমানিক ২৫ লক্ষ বছর পূর্বে আফ্রিকায় তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে জীবাশ্ম পরীক্ষার মাধ্যমে।

এরা দুপায়ে হাঁটতে পারতো। এতে দুহাতে বিভিন্ন প্রকার কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়।

ফলে এই প্রজাতিতেই প্রথম পাথরের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তাই বিজ্ঞানীরা এদের নাম দেয় “হেন্ডি ম্যান”।

 

হোমো ইরেক্টাস বা খাড়া মানব

 

erectus
erectus

 

মানুষ গণের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য প্রজাতি হচ্ছে “হোমো ইরেক্টাস”।

আনুমানিক ২০ লক্ষ বছর পূর্বে এদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়।

এ প্রজাতিতেই সর্বপ্রথম মানুষের চেহারা দেখা যায়।

খাড়া মানুষ শিকারে দক্ষ ছিল। শিকারের সুবিধার জন্য তারা বিভিন্ন রকম শব্দ উৎপন্ন করতে পারত।

অনুমান করা হয় যে এরাই মানুষ গণের প্রথম প্রজাতি যারা দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে আগুনের ব্যবহার শুরু করে।

আগুনে মাংস সিদ্ধ করে খেলে পরিপাকে কম শক্তি ব্যয় হয়। যা মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি করে। আর বড় মস্তিষ্ক মানেই হচ্ছে বেশি চিন্তা। অর্থাৎ মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি কল্পনা তথা চিন্তা করার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করতে থাকে।

সিদ্ধ মাংস খাওয়ায় দাতঁক্ষয় কম হয়, চোয়ালের আকার হ্রাস পায়।

আগুনের সাহায্যে শীত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়; আলো পাওয়া যায়, ফলে রাতে দেখতে সুবিধা হয়।

জীবনযাত্রার এসব মান উন্নয়ন মানুষের আয়ু বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

 

হোমো নিয়ান্ডার্থালেনসিস

 

neanderthal
neanderthal

 

মানব বিবর্তনে আধুনিক মানুষের মতোই উন্নত প্রজাতির মানুষ ছিল নিয়ান্ডার্থাল মানুষ।

৪ লক্ষ বছর আগে তাদের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে।

এদের মস্তিষ্ক আধুনিক মানুষের মতো বড় ছিল।

তারাই প্রথম পাথরের পাশাপাশি হাড়ের অস্ত্র ব্যবহার করে। উন্নত হাতিয়ারের মাধ্যমে জটিল শিকার করে।

বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে গুহার প্রাণিদের সরিয়ে গুহায় থাকতে শেখে।

এমনকি তাদের মধ্যে মৃতদের কবর দেওয়ারও প্রচলন ছিল।

তবে তারা আকারে আধুনিক মানুষ অপেক্ষা কিছুটা ছোট ছিল।

আনুমানিক ৩৫ হাজার বছর পূর্বে মানুষের এ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে রাজত্ব করা আধুনিক মানুষই তাদের মৃত্যুর কারণ। তবে অনেকে এটিও মনে করে যে তারা আধুনিক মানুষের সাথে মিশে গিয়ে আধুনিক মানুষের প্রজাতিকে আরও বড় করতে সহায়তা করেছে। ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষের ডিএনএতে সামান্য (১-২%) নিয়ান্ডার্থাল মানুষের ডিএনএ পাওয়া যায়।

 

আমরা তথা হোমো সেপিয়েন্স বা জ্ঞানী মানুষ বা আধুনিক মানুষ

 

 

মানুষ গণের সর্বশেষ প্রজাতি আমরা অর্থাৎ আধুনিক মানুষ।

আধুনিক মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম ‘হোমো সেপিয়েন্স’ যার অর্থ ‘জ্ঞানী মানুষ’। ল্যাটিন শব্দ

‘হোমো’ মানে ‘মানুষ’ এবং

‘স্যাপিয়েন্স’ মানে ‘জ্ঞানী’।

আনুমানিক আড়াই লক্ষ বছর পূর্বে আফ্রিকায় আধুনিক মানুষের জন্ম হয় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। তবে ৪০-৫০ হাজার বছর পূর্বে তারা পরিপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করে। অর্থাৎ বর্তমান রূপে আসে।

 

আধুনিক মানুষের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে:

  • দুপায়ে হাটতে পারার ক্ষমতা;
  • বিভিন্ন প্রকার যন্ত্র ব্যবহার করার ক্ষমতা;
  • তুলনামূলক বড় আয়তনের মস্তিষ্ক;
  • ছোট চোয়াল এবং
  • বৈচিত্র্যময় শব্দ সৃষ্টি ও বোঝার ক্ষমতা।

 

শেষোক্ত বৈশিষ্ট্য ব্যতীত অন্যান্য বৈশিষ্ট্য মানুষের অন্যান্য প্রজাতিতেই বিকশিত হয়েছিল।

যেমন দুপায়ে হাঁটতে পারার ক্ষমতা হেন্ডি ম্যানেরা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে লাভ করেছিল। তারা পাথরের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার রপ্ত করেছিল।

আগুনের ব্যবহার খাড়া মানবদের মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি ও চোয়ালের আয়তন হ্রাস করতে সহায়তা করে। উল্লেখ্য কিছু কিছু প্রাণীর মস্তিষ্ক মানুষের চেয়ে বড় হলেও বিশাল শারীরিক গঠনের জন্য মস্তিষ্ক চিন্তা করার জন্য উপযুক্ত নয়। মানুষের দেহের তুলনায় মস্তিষ্কের আয়তন বড় হওয়ায় মানুষের মস্তিষ্ক জটিল চিন্তা করার জন্য উপযুক্ত। অর্থাৎ আগুনের ব্যবহার আমাদের মস্তিষ্ককে এমনভাবে বিকশিত করে যাতে আমরা জটিল চিন্তা তথা কল্পনা করতে পারি।

 

যা হউক বৈচিত্র্যময় শব্দ সৃষ্টি করে ভাবের আদান-প্রদান করার ক্ষমতা অন্য কোন প্রাণী বা মানুষে নেই বললেই চলে। নিয়ান্ডারর্থালদের মধ্যে বৈচিত্র্যময় শব্দ সৃষ্টি করার সামান্য ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তাদের আধুনিক মানুষের মতো অর্থপূর্ণ বৈচিত্র্যময় শব্দ সৃষ্টি করে তথা ভাষার মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান করতে পারত না।

আমাদের ফুসফুস থেকে নির্গত বাতাস স্বরযন্ত্রের ভোকাল কর্ডকে কাঁপিয়ে তুললে শব্দ সৃষ্টি হয়। তারপর জিহ্বা সেই শব্দকে বিভিন্ন উপায়ে নাড়িয়ে বিভিন্ন আকৃতি প্রদান করে। এভাবেই সৃষ্টি হয় বৈচিত্র্যময় শব্দ।

 

how human produce sound
how human produce sound

 

শিকারের সুবিধার জন্য যখন মানুষ পরস্পরের সাথে বৈচিত্র্যময় শব্দ সৃষ্টি করে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করে তখন স্বরযন্ত্রের পরিবর্তন হয়। আনুমানিক ৬০ হাজার বছর পূর্বে মানুষের স্বরযন্ত্র গলার মাঝ বরারবার চলে এসে নড়নক্ষম হয়। এতে বৈচিত্র্যময় শব্দ সৃষ্টি সম্ভব হয়। অন্যান্য প্রাণীতেও এই বৈশিষ্ট্য সামান্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু জিহ্বাকে নাড়িয়ে শব্দকে আরও জটিল করার জন্য মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রকার শব্দ তৈরি করে তার আলাদা আলাদা অর্থ প্রদান করার জন্য মস্তিষ্কের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োজন। যা অন্য কোনো প্রাণী বা মানুষের অন্য প্রজাতিতে নেই। স্বরযন্ত্রের পরিবর্তনের কিছু সময় পর মস্তিষ্কের বিবর্তনের মাধ্যমে ভাষা প্রক্রিয়াকরণ ও ব্যবহারের জন্য অঞ্চল উন্নত হয়। অর্থাৎ শব্দকে অর্থ প্রদান করে ভাবের আদান-প্রদানের জন্য মস্তিষ্ক উপযুক্ত হয়।

 

অতএব আমরা বলতে পারি শারীরিক দিক থেকে আমরা এখন যেমন তার সূচনা হয় আজ থেকে আনুমানিক ষাট হাজার বছর পূর্বে।

  • প্রথমদিকে আগুনের ব্যবহার,
  • পরে ভাষার আবিষ্কার;

আমাদের মস্তিষ্ককে বিশেষ ক্ষমতা তথা

  • চিন্তা বা কল্পনা করার ক্ষমতা,
  • ভাষা তৈরি করার ক্ষমতা প্রদান করে।

যার ফলে আমরা জীবজগতের অন্য প্রাণী থেকে আলাদা হয়ে যাই। যা হউক এরপর দৈহিক দিক থেকে আর কোনো পরিবর্তন হয়নি।

 

মানুষ প্রজাতিতে বৈচিত্র্য

উল্লেখ্য আধুনিক মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার ফলে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়। যারা উত্তর মেরুর দিকে অত্যাধিক ঠান্ডা পরিবেশে বাস করতে থাকে সেখানকার পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য তাদের চামড়া সাদা হয়ে যায়। আর যারা উত্তর মেরু থেকে দূরে আফ্রিকায় বাস করে সূর্যালোক থেকে রক্ষা পেতে তাদের চামড়া কালো হয়ে যায়। অর্থাৎ বর্তমানে মানুষ প্রজাতিতে যে পার্থক্য দেখা যায় তা বাহ্যিক। শেতাঙ্গরা নিগ্রোদের থেকে উন্নততর নয়। নিগ্রোরা আমেরিকায় থাকলে তারাও একই রকম শারীরিক গঠন ও চিন্তাধারার অধিকারী হতো।

 

যা হউক আমরা দেখতে পাচ্ছি মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলো অন্য প্রাণীতে অল্প বিস্তর থাকলেও সবগুলো পরিপূর্ণতা লাভ করে আধুনিক মানুষে এসে। তারপর বুদ্ধির প্রভাবে মানুষের জীবনযাত্রার আলাদা ধরণ তৈরি হয়। মানুষ গড়ে তোলে সংস্কৃতি। এই যে বুদ্ধির জোড়ে মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন; বিজ্ঞানীরা একেই “বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব” নামে আখ্যা দিয়েছেন। যার ফসল আধুনিক মানুষের আজকের পৃথিবীতে রাজত্ব করা।

সম্পর্কিত অনুচ্ছেদসমূহ