আড়াই লক্ষ বছর পূর্বে মানুষের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ৭০ হাজার বছর পূর্বে তা প্রাণীজগতের অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা হয়ে ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। মানুষ সংস্কৃতি গড়ে তোলে। ১২ হাজার বছর পূর্বে কৃষি আবিষ্কারের পর সেই সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। বিজ্ঞানীরা এই ব্যাপক পরিবর্তন বা বিপ্লবকে ‘কৃষি বিপ্লব’ নাম দিয়েছে। কৃষি বিপ্লবের ফলে গঠিত কৃষি সমাজই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সভ্য সমাজ। মানুষের ইতিহাসের এই পর্বে থাকবে “পৃথিবীর প্রথম সভ্য সমাজ”-এর বর্ণনা।
প্রথমে চলুন জেনে নেই
কেন মানুষ শিকার ছেড়ে কৃষিকাজ ও পশুপালন করেছিল?
শিকারী সমাজের মানুষেরা খাবার সংরক্ষণ করতে পারত না। ফলে তাদের প্রতিদিন খাবার সংগ্রহ করতে হতো। কিন্তু আবহাওয়া জনিত বা অন্য কোনো কারণে খাবার সংগ্রহ করা সম্ভব না হলে তাদের না খেয়ে দিন কাটাতে হতো। অর্থাৎ শিকারীদের খাদ্যের নিশ্চয়তা ছিল না। প্রাকৃতিক শক্তি ও ভাগ্য অনুকূলে থাকলে শিকার জুটত।
তাছাড়া প্রকৃতির উপর (ঋতু পরিবর্তন) নির্ভর করত ফলমূল কেমন পাওয়া যাবে। আর যেহেতু তাদের খাবারের উদ্দেশ্যে কিছু দিন পর পর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেরাতে হতো; তাই নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতেও বেশ সমস্যা হতো।
আর কেবল শিকার ও ফলমূলের উপর নির্ভরশীল হওয়ার জন্য তাদের জনসংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সীমার বেশি হওয়া সম্ভব ছিল না। কৃষি বিপ্লবের পূর্বে সমগ্র পৃথিবীতে কেবল ৫০ লক্ষের কাছাকাছি মানুষ বাস করত।
মোটকথা হলো যাযাবর শিকারী জীবন মোটেই আরামদায়ক ছিল না।
অর্থাৎ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য শিকারী মানুষদের প্রয়োজন ছিল খাদ্যের নিশ্চয়তার।
এদিকে শিকারীরা বেশ কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। তারা জানতে পেরেছিল বীজ থেকে চারা জন্মায়, তা বড় হয়, একসময় তাতে ফুল ও ফল ধরে। ঋতু পরিবর্তন ও আবহাওয়ার সাথে এগুলো সম্পর্কিত। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এসব অভিজ্ঞতার বিনিময় শিকারী সমাজকে দিন দিন অভিজ্ঞ করে তোলে। তারা বীজ বপন করে পর্যবেক্ষণ করে ও গাছের বংশবৃদ্ধি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। এতে তারা ফসল ফলানোর মাধ্যমে খাদ্য সমস্যার সমাধান করার একটা সুযোগ পায়। তবে প্রথমদিকে কৃষিকাজ মোটেই সহজ ছিল না।
আনুমানিক ১২ হাজার বছর পূর্বে মানুষের প্রথম কৃষিকাজের প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্ভবত নারীদের হাত ধরেই শুরু হয় কৃষিকাজ। কারণ গর্ভধারণ, সন্তান প্রতিপালন, ফলমূল সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত থাকায় নারীরা তুলনামূলক কম ঘুরে বেরাতো। ফলে কোনো স্থানে পড়ে থাকা বীজ থেকে গাছ জন্মানো সম্পর্কে নারীদের জ্ঞান লাভ করার সম্ভাবনা বেশি ছিল। অন্যদিকে পুরুষেরা শিকারের উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্তে ঘুরে বেরাতো।
এদিকে খাদ্যের নিরাপত্তার জন্য পশু শিকার করার পর অতিরিক্ত পশুগুলোকে মেরে না ফেলে আটকে রেখে পরে সুবিধা অনুযায়ী মেরে খাদ্য সমস্যার সমাধান করা হতো। আর পশুদের আটকে রেখে, তাদের পর্যবেক্ষণ করতে করতেই শিকারীরা শিখে যায় পশুদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে। তাদের মাংস ছাড়াও দুধ, ডিম, চামড়ার ব্যবহার বাড়তে থাকে। বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে পশুদের সংখ্যা বাড়ানো হয়। এমনকি পশুদের কৃষিকাজেও লাগানো হয়। আর এসব অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই শুরু হয় পশুপালন।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে শিকারে সাহায্য করার জন্য আনুমানিক ১৬ হাজার বছর পূর্বে মানুষ প্রথম কুকুরকে বশ করেছিল। আর ১২ হাজার বছর পূর্বে কৃষিকাজ শুরু হওয়ার পর গৃহপালিত পশুপালন শুরু হয়।
যা হউক খাদ্যের নিশ্চয়তার জন্য শিকারীরা কৃষিকাজ ও পশুপালনের দিকে ঝুকেঁ। এতে কেবল তাদের খাদ্য সমস্যার সমাধান হয়নি। জীবনযাত্রার ব্যাপক পরিবর্তন; তথা মান উন্নয়ন হয়। অসভ্য বন্য মানুষ সভ্য সমাজ গড়ে তোলে।
চলুন সেসব বিষয় জেনে নেই।
কৃষি সমাজের বৈশিষ্ট্য
স্থায়ী বাসস্থান
শিকারী যুগে মানুষ বন্য পশুদের অনুসরণ করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেরাতো। তারা ছিল যাযাবর। কিন্তু কৃষিকাজ শুরুর পর মানুষকে বীজ বপন থেকে ফসল ফলা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় এক স্থানে বসবাস করতে হতো। এতে তাদের স্থায়ী ঘরবাড়ি তৈরির প্রয়োজন পরে। যাযাবর মানুষ গৃহবাসী হয়।
শ্রম বন্টন
কৃষি সমাজে মানুষ সুযোগ পেলে শিকার করত, কৃষিকাজ করত, ফলমূল সংগ্রহ করত, পশুপালন করত, ফসল সংরক্ষণ করত। এসব কাজ একা কোনো ব্যক্তির পক্ষে করা কষ্টসাধ্য। তাই তারা কাজ ভাগ করে নিত। সময়ের সাথে সাথে কাজের পরিধি আরও বাড়তে থাকল। ঘরবাড়ি নির্মাণের প্রয়োজন পড়ল, কৃষির সরঞ্জাম প্রস্তুতের জন্য কামার-কুমার শ্রেণির জন্ম হলো, ফসল সংরক্ষণের জন্য যোদ্ধা শ্রেণির উদ্ভব হলো ইত্যাদি। এই শ্রম বন্টনই কালের পরিক্রমায় স্থায়ী হয়ে বিভিন্ন পেশায় পরিণত হয়।
ব্যক্তিগত সম্পত্তি
শিকারী যুগের মতোই কৃষি যুগের প্রথম দিকে কোনো গোষ্ঠী কর্তৃক উৎপাদিত সকল ফসল ঐ গোষ্ঠীর সদস্যরা ভাগ করে খেত। আর উদ্বৃত্ত ফসল জমা রাখত ভবিষ্যতের জন্য। কখনো কখনো দুটি গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের মাধ্যমে অন্যের ফসল ছিনিয়ে নিত। এ কারণেই ফসল রক্ষা করতে জন্ম হয় যোদ্ধা শ্রেণির। কালক্রমে গোষ্ঠীর সদস্যরা জমি ভাগ করে ফসল ফলানো শুরু করে। এতে গোষ্ঠীর সম্পত্তির স্থলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব হয়।
সামাজিক কাঠামো
শিকারী যুগে প্রতিটি গোষ্ঠীতে যে অস্থায়ী দলনেতা নির্বাচন করা হতো শিকারী যুগ শেষ হতে হতে তা স্থায়ী রূপ লাভ করেছিল। কৃষিযুগে গোষ্ঠীর আকার বৃদ্ধি পাওয়ায় দলনেতা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। দলনেতাই প্রত্যেক ব্যক্তিকে জমি ভাগ করে দিত। শ্রম বন্টন করে দিত। গোষ্ঠীর সকলে তার আদেশ মান্য করত।
গোষ্ঠীর আকার বড় হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কিছু সাধারণ নিয়ম-কানুন প্রবর্তন করা হয়। যা পরবর্তীতে আইনে রূপান্তরিত হয়। পরস্পরকে সহায়তা করা এবং জৈবিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গোষ্ঠীর কিছু সংখ্যক নারী পুরুষকে একত্রে থাকার বৈধতা দেওয়া হয়। কালক্রমে এটিই স্থায়ী পরিবারে রূপান্তরিত হয়। তবে কৃষিযুগের পরিবার একাধিক পুরুষ ও একাধিক মহিলা নিয়ে গঠিত ছিল। সময়ের সাথে সাথে এটি ছোট হতে থাকে।
কৃষি যুগে পরিবার ছিল পিতৃতান্ত্রিক।
অবসর সময়
খাদ্যের নিশ্চয়তা মানুষকে অবসর সময় দেয়।
আর এই অলস সময় কাটাতেই সমৃদ্ধ হয় ভাষা, সৃষ্টি হয় শিক্ষা, উন্নত হয় শিল্প।
যেমন অলস সময়ে গল্প গুজব করার জন্য প্রয়োজন পড়ে সমৃদ্ধ ভাষার। ভাষা বিকশিত হওয়া শুরু হয়।
শুরু হয় জ্ঞান চর্চা। তারা যে স্থানে বসে এই অলস সময় কাটাত তথা জ্ঞান চর্চা করত সেটাই বর্তমানে পরিবর্তিত হয়ে স্কুলে রূপান্তরিত হয়েছে। ‘স্কুল’ শব্দটি এসেছে গ্রিক ‘ল্যাসার’ বা ‘অলস’ শব্দ থেকে। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থার সৃষ্টি এই অলস সময় কাটানোর জন্যই হয়েছিল।
শিল্পের বিকাশও এই সময়ে হয়। কৃষিকাজের জন্য সরঞ্জাম তৈরি হয়। হস্তশিল্প, মৃৎ শিল্প, বস্ত্র ও তাঁত শিল্পের জন্ম হয়। অলঙ্কারগুলো আরও উন্নত হয়। গুহাচিত্রে যুক্ত হয় কৃষিকাজের ছবি।
মানুষ চিন্তা করার জন্য বেশি সময় পায়। প্রযুক্তির উন্নতি সাধন হয়। কৃষিকাজের জন্য লাঙল, সেচ ব্যবস্থার উন্নতি হয়। শেষের দিকে মানুষ চাকার খোঁজ করে।
বিনিময় ও বাণিজ্য
সমাজে শ্রম বিভাগ থাকায় প্রয়োজন অনুযায়ী মানুষ নিজেদের সম্পত্তি বিনিময় করত। যেমন বনভূমির মানুষ কাঠের কাজ ভালো পারত। তারা চমৎকার ঘর বানাতে পারত। অন্যদিকে তৃণভূমির মানুষ হাড়, চামড়া, বাঁশ ও বেতের কাজ ভালো পারত। চাহিদা অনুযায়ী তারা এগুলো বিনিময় করত। বিনিময়কে সহজতর করতেই পরবর্তীতে মুদ্রার ধারণা আসে।
আর উদ্বৃত্ত সম্পত্তি থেকে আসে বাণিজ্যের ধারণা। জন্ম হয় বিলাসিতার।
অবশ্য তাদের মধ্যে কেবল সম্পত্তি নয় আবিষ্কারের বিনিময়ও হতো।
শেষের দিকে সম্পত্তির হিসাব রাখার জন্য লিখন পদ্ধতির উদ্ভব হয়।
ধর্ম ও বিশ্বাস
কৃষিকাজের জন্য মানুষ প্রাকৃতিক শক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল। এজন্য তারা প্রাকৃতিক শক্তির পূজা করত। পশু পালন ও শিকারের জন্যও দেবতার আরাধনা শুরু হয়। এতে ধর্ম চর্চা বাড়ে। পুরোহিতের গুরুত্ব বাড়ে। উপাসনালয়ের প্রচলনও কৃষিযুগ থেকে শুরু হয়। মৃত্যু, আত্মা, পুনর্জন্ম, ভূত-প্রেত ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা বাড়তে থাকে। ফলে আচার অনুষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
উল্লেখ্য কৃষি যুগে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কোথাও কৃষি যুগ আগে প্রবেশ করে তো কোথাও কিছুটা পরে। কোথাও ভুট্টার চাষ ভালো হয় (আমেরিকা) আবার কোথাও ধান (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া)। কোনো কোনো স্থানের মানুষ যন্ত্রের ব্যবহারে বেশ এগিয়ে যায়। আবার কোনো স্থানে শিল্পকর্মে এগিয়ে যায়। ফলে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে কৃষিসমাজের বৈশিষ্ট্য হয় বিভিন্ন রকম। আনুমানিক ১২ হাজার বছর পূর্ব থেকে স্থায়ী সভ্যতা গড়ে উঠার পূর্ব পর্যন্ত এসব বৈশিষ্ট্য কৃষি সমাজে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়।
যা হউক আমরা দেখতে পাচ্ছি কৃষির আবিষ্কার মানুষের সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দেয়। বিজ্ঞানীরা এই ব্যাপক পরিবর্তন বা বিপ্লবকেই ‘কৃষিবিপ্লব’ নামে আখ্যা দিয়েছে।
ধন্যবাদ।