বাঙালি জাতি বলতে আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠীকে বুঝি। এদের স্থায়ী নিবাস বর্তমান বাংলাদেশে। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের কয়েকটি অঞ্চল এবং প্রবাসী বাঙালিসহ বর্তমান পৃথিবীর প্রায় ৩০ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে।
নৃতত্ত্ব অনুসারে বাঙালি জাতি একটি সংকর বা মিশ্র জাতি। মোট জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ৬০ ভাগ অস্ট্রেলীয়, ২০ ভাগ মঙ্গোলীয়, ১৫ ভাগ নেগ্রিটো এবং বাকি ৫ ভাগ অন্যান্য নরগোষ্ঠীর। অর্থাৎ অস্ট্রিক, মঙ্গোল, নেগ্রিটো ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর কোন না কোন শাখার মিশ্রণ বাঙালি জাতিতে রয়েছে। তাইতো সাদা, কালো, লম্বা, খাটো বিভিন্ন রকম মানুষ এ জাতিতে পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হল এসব জাতির মিশ্রণে, কখন এবং কীভাবে বাঙালি জাতির উৎপত্তি হয়েছে? এক কথায় এর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন জাতির মিশ্রণে বাঙালি জাতির উৎপত্তি হয়েছে। চলুন ধারাবাহিকভাবে জানতে চেষ্টা করি।
……
প্রাচীন যুগে যখন বাংলা ভাষা ও বঙ্গ রাজ্যের উদ্ভব হয়নি; তখন এ অঞ্চলে যে জাতি বসবাস করত তারা ছিল কালো, খাটো প্রকৃতির মানব। এ জাতির নাম ছিল নেগ্রিটো। এরা ভীল, সাওতাঁল, মুন্ডা প্রভৃতি উপজাতির পূর্বপুরুষ। এদের সভ্যতা বলতে তেমন কিছু ছিল না। আসলে তখন সভ্যতার সূত্রপাতই হয়নি।
৫০০০ বছর পূর্বে মানে সভ্যতার ঊষালগ্নে অস্ট্রিক ভাষাভাষী লোকেরা বঙ্গে আসে। অষ্ট্রিকদের আদিনিবাস পূর্বচীনে। অনেকে এদের নিষাদ জাতি বলে থাকে। এরাও তুলনামূলক খাটো ও কুৎসিত চেহারার ছিল। এদের সভ্যতা বলতে তেমন কিছু না থাকলেও অন্তত নেগ্রিটো থেকে উন্নত ছিল। এরা আসাম হয়ে বাংলায় আসে। বাংলায় এসে এরা প্রথমেই অনুন্নত নেগ্রিটোদের বাংলা থেকে উৎখাত করে। বাঙালি জাতির প্রধান অংশ অস্ট্রিক জাতি থেকেই গড়ে উঠে।
প্রায় একই সময়ে, মানে ৫০০০ বছর পূর্বে বা তার কিছু পরে দ্রাবিড় নামক আর এক জাতি বাংলায় আসে। এই দ্রাবিড়রা ছিল দক্ষিণ ভারতের আদি অধিবাসী। এদের সভ্যতা অস্ট্রিকদের থেকে আর একটু উন্নত ছিল। বাংলায় এসে দ্রাবিড়রা আস্তে আস্তে অস্ট্রিকদের গ্রাস করতে থাকে। ফলে অস্ট্রিক-দ্রাবিড় মিশ্রণে এক নতুন জাতির উদ্ভব হয় এবং এরাই বাংলায় বসবাস করতে থাকে। এখানে একটি কথা বলে রাখি, তখনও বঙ্গ রাজ্য ও বাংলা ভাষার জ্ন্ম হয়নি। খ্রীস্টপূর্ব দশম শতকে ইন্দো-আর্যদের এখানে আসার পর অঙ্গ, বঙ্গ এবং মগধ রাজ্য গঠিত হয়। এসব রাজ্যের বর্ণনা প্রথম পাওয়া যায় অথর্ববেদে। আর বাংলা ভাষার উদ্ভব হয় খ্রিস্টীয় ৭ম থেকে ১০ম শতাব্দীতে। ‘বাংলা ভাষার উৎপত্তি’ অধ্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আপাতত বাঙালি জাতির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা যাক।
সময় বইতে থাকল। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে জন্ম নিতে থাকল নানা রকম সভ্যতা। বর্তমান মধ্য এশিয়ার ইরানে, ইউরাল পর্বতের দক্ষিণে যে জাতি গড়ে উঠেছিল তাদের বলা হতো আর্য জাতি। এরা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলত। এরা সকলেই সনাতন ধর্মাবলম্বী এবং এদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ছিল বেদ। আর্যদের সভ্যতাকে বলা হতো বৈদিক সভ্যতা। বৈদিক সভ্যতা যথেষ্ট উন্নত ছিল। তারা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। এমনকি বন্যপশু ঘোড়াকেও তারা পোষ মানিয়েছিল। আফগানিস্তানের খাইবার গিরিপথ দিয়ে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে বা তার কিছু আগে তারা বাংলায় প্রবেশ শুরু করে।
অস্ট্রিক-দ্রাবিড় মিশ্রণে যে জাতি গড়ে উঠেছিল তারা তখনও বাংলায় বসবাস করছে। এই মিশ্রিত জনগোষ্ঠীর সাথেই আর্যজাতি মিশ্রিত হয়ে বাঙালি জাতির উৎপত্তি হয়েছে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
পরে অস্ট্রিক-দ্রাবিড় মিশ্রিত জাতির সাথে মঙ্গোলীয় বা ভোটচীনীয় জাতির সংমিশ্রণ ঘটে। বাংলাদেশে আর্যকরণের পরে এদের আগমন বলে বাঙালির রক্তে এদের মিশ্রণ উল্লেখ্যযোগ্য নয়। গারো, কোচ, ত্রিপুরা, চাকমা এই গোষ্ঠীভুক্ত।
খ্রিস্টীয় ৮ম শতাব্দীর দিকে সেমীয় গোত্রের আরবীয়রা ইসলাম প্রচার ও ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাংলায় আসে। এতে বাঙালি জাতির সঙ্গে তাদের রক্ত মিশে যায়।
আরবীয়দের অনুকরণে নেগ্রিটো রক্তবাহী হাবশীরাও বাংলায় আসে। ফলে তাদের সাথেও বাঙালি জাতির মিশ্রণ ঘটে।
এমনিভাবে তুর্কি, আফগান, ইরানি, মোগল প্রভৃতি জাতি বাংলায় আসে। তারাও পূর্ববর্তীদের সাথে মিশতে থাকে।
সবশেষে ইউরোপীয় তথা পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, দিনেমার, ইংরেজ, ফরাসি প্রভৃতি জাতিরাও বাংলায় এসে বসবাস করে। এভাবে হাজার বছরেরও অধিক সময়ের অনুশীলন, গ্রহণ, বর্জন এবং রুপান্তিকরণের মাধ্যমে যে সংকর জাতির উৎপত্তি হয়েছে, তাই বাঙালি জাতি।
সহায়ক তথ্য:
নৃবিজ্ঞান: বিজ্ঞানের যে শাখায় মানুষ নিয়ে গবেষণা করা হয় তাকে নৃবিজ্ঞান বলে। মানব সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, মানুষের আচরণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করাই এ শাখার কাজ।
নরগোষ্ঠী: পৃথিবীর প্রধান চারটি নরগোষ্ঠী হলো: নিগ্রো, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় ও অস্ট্রেলীয়।
পূর্বচীন: ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া এসব দেশকে বলা হয় ইন্দোচীন।
আর্য: আর্য শব্দের অর্থ সম্মানীয় ব্যক্তি।
খাইবার গিরিপথ: আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে সংযোগকারী একটি পার্বত্য গিরিপথের নাম খাইবার গিরিপথ।