বাংলা ভাষার উৎপত্তি

বাংলা ভাষার উৎপত্তি
বাংলা ভাষার উৎপত্তি

বর্তমানে পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারের বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে বাংলা একটি। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম মাতৃভাষা। বর্তমান পৃথিবীর (২০২৪) প্রায় ৩০ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের কয়েকটি অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। এই বাংলা ভাষার উদ্ভব কীভাবে হয়েছে এবং কীভাবে তা বর্তমান রূপ লাভ করেছে, চলুন জেনে নেওয়া যাক।

 

…..

৫০০০ বছর আগের কথা। তখন ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ইত্যাদি রাষ্ট্র ছিল না। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ আশেপাশের রাষ্ট্রসমূহ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষার সাথে ইউরোপীয়দের ভাষার মধ্যে অনেক মিল ছিল।

পাশাপাশি দুটি দেশের ভাষা একই রকম হলে তাদের ভাষাবংশ বলে। উদাহরণসরূপ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উভয়ের ভাষা বাংলা। তবে এদের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। যেহেতু ভারতীয় উপমহাদেশ ও ইউরোপীয়দের ভাষা একই রকম ছিল, তাই এরা একই ভাষাবংশের অন্তর্ভুক্ত। এই ভাষাবংশের নাম ছিল ইন্দো-ইউরোপীয়। এখানে ইন্দো বলতে ভারতীয় বোঝানো হচ্ছে।

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের দুটি শাখা। যথা: শতম ও কেন্তুম। ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা যে ভাষায় কথা বলত তাকে বলা হতো শতম। আর ইউরোপীয়রা যে ভাষায় কথা বলত তাকে বলা হতো কেন্তুম।

আবার একই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা বিভিন্ন রকম। এদের বলা হয় আঞ্চলিক ভাষা। যেমন সিলেট, ময়মনসিংহ, বরিশাল প্রভৃতি জেলার ভাষা বাংলা হলেও আলাদা আলাদা আঞ্চলিক ভাষা আছে। যেহেতু ভারতীয় উপমহাদেশ অনেক বড় ছিল তাই অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার মধ্যেও কিছু পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। আঞ্চলিক ভাষার নাম অঞ্চল অনুসারে দেওয়া হয়। যেমন আরবের লোকেরা আরবীয় ভাষায় কথা বলত, মিশরের লোকেরা মিশরীয় এবং ভারতবর্ষের লোকেরা ভারতীয় ভাষায় কথা বলত। তবে এই আরবীয়, মিশরীয়, ভারতীয় সবগুলোই শতমের শাখা। আমাদের ভূখন্ডের মানে বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার পর স্থানীয় ভাষার সাথে আর্যদের ভাষা মিশে তা ভারতীয়-আর্য নামে পরিচিত হয়। এই ভারতীয়-আর্য ভাষার দুটি রুপ। যা লিখে প্রকাশ করা হতো, মানে লিখিত রুপ তা সংস্কৃত নামে পরিচিত হয়। পন্ডিতগণ, মূলত পাণিনি, একে সংস্কার করে সাহিত্যের রূপ দেন। সংস্কারজাত বলেই এ রূপটি সংস্কৃত নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে ব্রাহ্মণ ছাড়া কেউই এ রূপ ব্যবহার করত না। সাধারণ লোকের মুখের ভাষা অর্থাৎ ভারতীয়-আর্য ভাষার মৌখিক রুপটি প্রাকৃত নামে পরিচিত ছিল।

প্রাকৃত ভাষার মধ্যে গৌড়ের লোকেরা গৌড়ীয় প্রাকৃত এবং মগধের লোকেরা মাগধী প্রাকৃত ভাষায় কথা বলত। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে মাগধী প্রাকৃত থেকে খ্রিষ্টীয় ১০ম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার জন্ম হয়। আর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর মতে গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার জন্ম হয়। বাংলাদেশী হিসাবে আমরা সব সময় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর মতকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আর পশ্চিবঙ্গের বাঙালিরা ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতামতকে বেশি প্রাধান্য দেয়। যা হউক গৌড়ীয় প্রাকৃতই হউক অথবা মাগধী প্রাকৃতই হউক একসময় এ ভাষা বিকৃত হয়ে যায়। ভাষা যখন বিকৃত হয়ে যায় তখন তাকে ভাষা নয়, অপভ্রংশ বলা হয়। গৌড়ীয় প্রাকৃত এবং মাগধী প্রাকৃতের বিকৃত অপভ্রংশ থেকে যে ভাষার উদ্ভব হয়, তাকে বলে বঙ্গকামরূপী। বঙ্গকামরূপী থেকে সরাসরি কিছু ভাষা উৎপন্ন হয় যাদের মধ্যে বাংলা অন্যতম। বঙ্গকামরূপী থেকে উৎপন্ন অন্যান্য ভাষাসমূহ হচ্ছে অসমিয়া, উড়িয়া ইত্যাদি। এ কারণে এদেরকে বাংলার সহোদর বলা হয়।

 

সহায়ক তথ্য:

সময়: ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর মত অনুসারে বাংলা ভাষার জন্মের বিভিন্ন স্তরের সময়কাল:

ক. ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা (অনুমানিক ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)

খ. শতম (৩৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)

গ. আর্য ভাষা (২৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)

ঘ. ভারতীয় (১৫০০-১২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)

ঙ. প্রাচীন ভারতীয় আর্য (১০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)

চ. প্রাচী প্রাকৃত (৮০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)

ছ. সংস্কৃত (৬০০-)

জ. প্রাচীন প্রাচ্য (৪০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ)

ঝ. গৌড়ীয় প্রাকৃত (২০০ খ্রিস্টাব্দ)

ঞ. গৌড়ীয় অপভ্রংশ (৪০০- ৬০০ খ্রিস্টাব্দ)

ট. বঙ্গকামরূপী (৫০০ খ্রিস্টাব্দ)

ঠ. বাংলা (৬৫০ খ্রিস্টাব্দ)

প্রাকৃত: ‘প্রাকৃত’ শব্দের শাব্দিক অর্থ ‘স্বাভাবিক’। আর ভাষাগত অর্থ ‘জনগণের ভাষা’।

সম্পর্কিত অনুচ্ছেদসমূহ