বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস

বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস
বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস

বাঙালিদের প্রধান বাসস্থান বাংলাদেশ। এছাড়া ভারতের কিছু রাজ্য, যেমন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ইত্যাদি অঞ্চলে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রবাসী বাঙালিরা বসবাস করে। মূলত এই অঞ্চলটিতেই বাঙালিরা বেশি বাস করে বা করত। তবে বর্তমানে আমরা অঞ্চলটিকে যেভাবে চিনি পূর্বে তা এরূপ ছিল না। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এ অঞ্চলের বিবর্তন ভালোভাবে বুঝতে আমরা এ অঞ্চলের ইতিহাসকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা:

১. প্রাচীন যুগ

২. মধ্য যুগ (ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব পর্যন্ত) এবং

৩. আধুনিক যুগ।

 

১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি তথা মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের মাধ্যমে বাংলার ইতিহাসে মধ্যযুগ শুরু হয়। তার পূর্বে প্রাচীন যুগ এবং তারও পূর্বে অলিখিত অনুমাননির্ভর যুগকে প্রাগঐতিহাসিক যুগে বলে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে বাংলায় মানব বসতির অস্তিত্ব থাকায় বাংলার ইতিহাস প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই শুরু হয়। তারপর প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এবং সবশেষে ইউরোপীয়দের বাংলা দখলের মাধ্যমে শুরু হয় আধুনিক যুগ। এবার চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

 

প্রাগৈতিহাসিক যুগে বাংলা:

প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় জীবাশ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে প্রস্তর তথা শিকারি যুগে বাংলায় মানুষ বাস করেছিল। তবে তারা যাযাবর ছিল বলে স্থায়ীভাবে বাস করেনি। বাংলায় স্থায়ীভাবে বাস করেছিল নেগ্রিটোরা। কারণ তারা অল্প বিস্তর কৃষিকাজ জানত। ‘বাঙালি জাতিরি উৎপত্তি’ অংশে আমরা আলোচনা করেছি যে আর্যদের বাংলায় আসার পূর্বে নেগ্রিটোদের অস্ট্রিক জাতি উৎখাত করে। কারণ অস্ট্রিকরা সভ্যতায় নেগ্রিটোদের থেকে উন্নত ছিল। তারপর আর একটু উন্নত সভ্যতার অধিকারী দ্রাবিড়রা বাংলায় আসে এবং অস্ট্রিকদের সাথে মিশতে থাকে। এভাবে অস্ট্রিক-দ্রাবিড় মিশ্রণে একটি সংকর জাতি বাংলায় বাস করতে থাকে। তাদের সভ্যতা বলতে তেমন কিছু ছিল না। তবে সম্ভবত সিন্ধু নদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা সিন্ধু সভ্যতার (খ্রি.পূ. ৩৩০০ থেকে খ্রি. পূ. ১৩০০) কিছুটা ছোঁয়া এ অঞ্চলে লেগেছিল।

খ্রি.পূ. ১৫০০ অব্দে আর্যরা ভারতবর্ষে আসে। আর্যদের সভ্যতা যথেষ্ট উন্নত ছিল। তাদের সভ্যতাকে বলা হতো বৈদিক সভ্যতা। বৈদিক সভ্যতার প্রধান ধর্মগ্রন্থের নাম বেদ। আর্যদের ভারতবর্ষ আসার পর অঙ্গ, বঙ্গ এবং মগধ রাজ্য গঠিত হয়। খ্রি.পূ. ১০০০ অব্দে অথর্ববেদে এসব রাজ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের ঐতেরেয় আরণ্যক গ্রন্থেও ‘বঙ্গ’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ বাংলা অঞ্চলের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন নাম ছিল ‘বঙ্গ’।

বৈদিক যুগে এসব ছোট ছোট রাজ্যকে ‘জনপদ’ বলা হতো। পাশাপাশি আরও কয়েকটি জনপদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পুন্ড্র, গৌড়, বরেন্দ্র, রাঢ়, চন্দ্রদ্বীপ, সমতট, হরিকেল ইত্যাদি।

তৎকালীন ভারতবর্ষ এরূপ অসংখ্য ছোট ছোট রাজ্য বা জনপদে বিভক্ত ছিল। সময়ের সাথে সাথে কয়েকটি জনপদ মিলে গঠিত হয় একটি মহাজনপদ। সমগ্র ভারতবর্ষ এরূপ ১৬টি মহাজনপদে বিভক্ত ছিল। মহাজনপদসমূহ হলো:

অবন্তী, অস্মক,অঙ্গ, কম্বোজ, কাশী, কুরু, কোশল, গান্ধার, চেদি রাজ্য, বজ্জি অথবা বৃজি, বৎস রাজ্য, পাঞ্চাল, মগধ, মৎস্য অথবা মচ্ছ, মল্ল রাজ্য এবং শূরসেন।

যা হউক এ পর্যন্ত ইতিহাস সম্পূর্ণ অনুমাননির্ভর। কোন লিখিত নিদর্শন না থাকায় আমরা একে প্রাগৈতিহাসিক যুগ বলে গণ্য করতে পারি।

 

প্রাচীন যুগে বাংলা:

মহাজনপদসমূহের মধ্যে মগধ সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। ৪র্থ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মগধ শাসন করত নন্দ বংশ। এখান থেকেই ভারতবর্ষ তথা বাংলার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়। তাই বাংলার প্রাচীন ইতিহাস মূলত এখান থেকেই শুরু হয়। নন্দ বংশের শেষ সম্রাট ধননন্দ ছিলেন একজন অত্যাচারী শাসক। বিদেশি আক্রমণ সম্পর্কেও ছিলেন উদাসীন। ফলে চাণক্য নামক এক পন্ডিত ব্রাহ্মণ ভারতবর্ষের সুরক্ষার কথা ভেবে তার শিষ্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে মগধের সম্রাট বানানোর শিক্ষা দেন। ৩২১ খ্রি.পূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ধননন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসনে আরোহন করেন তথা ভারতবর্ষে মৌর্য সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। এই মৌর্য সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক সমগ্র বাংলা তথা বঙ্গ জনপদকে মগধের অন্তর্ভুক্ত করেন।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এসব জনপদ ছিল স্বাধীন। ‘প্রাচীন বাংলার জনপদ’ অংশে আমরা এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। মৌর্য শাসনামলে সম্রাট অশোক এসব অঞ্চলকে মগধের অন্তর্ভুক্ত করে। মৌর্যদের পর গুপ্তরা বাংলার এসব অঞ্চল শাসন করে। তারপর গুপ্ত রাজার এক মহাসামন্ত শশাঙ্ক স্বাধীন বঙ্গ ও গৌঢ় রাজ্য স্থাপন করে। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর এক অরাজকতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ইতিহাসে একে অভিহিত করা হয়েছে মৎস্যান্যায় নামে। এ অবস্থার সমাপ্তি ঘটাতে সর্বসম্মতিক্রমে গোপাল নামক এক ব্যক্তিকে বাংলার রাজা ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল বংশের শাসন। পালদের দীর্ঘদিন (প্রায় ৪০০ বছর) বাংলা শাসনের পর হিন্দু ধর্মাবলম্বী সেন বংশ বাংলা শাসন করতে থাকে।

 

মধ্যযুগে বাংলা:

১২০৪ সালে সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলায় মুসলিম শাসন শুরু করেন। তিনি দিল্লি সালতানাতের অধীন হওয়ায় বাংলা আবার পরাধীন হয়ে যায়।

কিন্তু পরাধীন হলেও বাংলা কখনই পরাধীন থাকতে চায়নি। ছোটখাট বিদ্রোহ লেগেই থাকত। তাইতো ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানী বাংলাকে ‘বুলগাকপুর’ বা ‘বিদ্রোহের নগরী’ নামকরণ করেছিলেন। যা হউক মোগল আমলের শেষের দিকে বাংলা আবার স্বাধীন হয়ে যায়। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম ইত্যাদি অঞ্চলকে একত্রে নাম দিয়েছিলেন ‘বঙ্গ’।

 

আধুনিক যুগে বাংলা:

ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপীয় বণিকরা বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষ আসে। কিন্তু ক্রমে তারা ভারতবর্ষ দখল করে ঔপনিবেশিক শাসন শুরু করে যার শুরুটা বাংলা থেকেই হয়েছিল। ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত করার মাধ্যমেই বাংলায় ইউরোপীয় তথা বিট্রিশরা রাজ করতে থাকে। বাংলাকে তারা বলত ‘বেঙ্গল’। শাসনকার্যের সুবিধার্থে ১৯০৫ সালে ব্রিটিশরা বাংলা বা বঙ্গকে ভাগ করে যা ইতিহাসে ‘বঙ্গভঙ্গ’ নামে পরিচিত। বঙ্গভঙ্গের ফলে সৃষ্টি হয় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ। তবে বাঙালিদের কাছে বঙ্গভঙ্গ মাকে ভাগ করার সমান ছিল। ফলে তারা আন্দোলন করে। চাপে পড়ে ব্রিটিশ সরকারকে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ বা বাতিল ঘোষণা করতে হয়। কিন্তু ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় ১৯৪৭ সালে বঙ্গকে আবার ভাগ করে যায়। পশ্চিমবঙ্গ হয়ে যায় ভারতের অংশ আর পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশ হয় পাকিস্তানের অংশ।

জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ববঙ্গের মানুষদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করে। রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার মাধ্যমেই যার শুরু। ফলে বাঙালিদের রক্ত ঝড়াতে হয় মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত করতে। বিকাশ ঘটে বাঙালি জাতীয়তাবাদের। তারপর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, সংবিধান আন্দোলন, ৬দফা আন্দোলন, গণঅভ্যত্থান ইত্যাদি ঘটনা এটা স্পষ্ট করে যে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। যার চুড়ান্ত পরিণতি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে দেড় লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ অর্জন করে তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।

তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে এক তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির দিকে। পরিণত হয়েছে উন্নয়নের রোল মডেলে। আর আমরা আশাবাদী শিঘ্রই তা পূর্ণতা পাবে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে।

সম্পর্কিত অনুচ্ছেদসমূহ