সৌরজগৎ

সৌরজগৎ
সৌরজগৎ

আমরা জানি সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহগুলো অনবরত ঘুরছে। এই চিরন্তন সত্যটি সপ্তদশ শতাব্দীতে গ্যালিলিও সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। শুধু গ্রহ নয়, সূর্যকে কেন্দ্র করে আরও অনেক মহাজাগতিক বস্তু ঘূর্ণায়মান রয়েছে। সূর্যকেন্দ্রিক এই ব্যবস্থার নাম সৌরজগৎ। পৃথিবীর তুলনায় সৌরজগৎ ৩৬ বিলিয়ন গুণ বড়।

বিশাল এই সৌরজগৎ সম্পর্কে জানতে আমাদের আজকের নিবেদন ‘সৌরজগৎ’।

 

………..

সৌরজগৎ কী? জন্ম ও অবস্থান

সূর্য এবং তার সাথে অভিকর্ষজটানে আবদ্ধ সকল মহাজাগতিক বস্তু নিয়ে গঠিত ব্যবস্থাই সৌরজগৎ। আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্রস্থল থেকে ২৭,০০০ আলোকবর্ষ দূরে কালপুরুষ বাহুতে সৌরজগৎ অবস্থিত।

৪.৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে একটি দৈত্যাকার আন্তঃনাক্ষত্রিক আণবিক মেঘের মহাকর্ষীয় পতনের ফলে সৌরজগতের উদ্ভব হয়। এটি আকাশগঙ্গা ছায়াপথের জানা ৫০০ এর অধিক নক্ষত্র জগতের একটি। তবে ছায়াপথটিতে এর চেয়ে আরও লক্ষ গুণ বেশি নক্ষত্রজগৎ থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা প্রতিবছর অন্তত একটি নক্ষত্রজগৎ আবিষ্কার করছে।

 

সৌরজগত আবিষ্কারের ইতিহাস

আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের ইতিহাস পাওয়া যায় সেই মেসোপটেমিয়া সভ্যতেই। তারা বেশ কিছু গ্রহ-নক্ষত্র আবিষ্কারও করতে পেরেছিল। সেকালে ধারণা ছিল আকাশে বিদ্যমান বস্তুসমূহ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে। পৃথিবী এই ব্যবস্থার কেন্দ্র। পর্যায়ক্রমে গ্রহ নক্ষত্রের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এমনকি সৌরকেন্দ্রিক ব্যবস্থার কথাও প্রস্তাব করা হয়। তবে সকলে পৃথিবীকেন্দ্রিক ব্যবস্থাকেই মেনে নেয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে গ্যালিলিও নিজের আবিষ্কৃত দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করে প্রথম সৌরকলঙ্ক ও বৃহস্পতির চারটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ আবিষ্কার করেন। তিনি সৌরকেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই চিরন্তন সত্যটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য গ্যালিলিওকে কারাবরণ করতে হয়েছিল।

গ্যালিলিও এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ক্রিস্টিয়ান হিউজেনস শনির উপগ্রহ টাইটান ও শনির বলয়ের বিশেষ আকৃতিটি আবিষ্কার করেন। ১৭০৫ সালে এডমন্ড হ্যালি প্রস্তাব করেন, একটি বিশেষ ধূমকেতুই প্রতি ৭৫-৭৬ বছর অন্তর অন্তর ফিরে আসে। এসব আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, গ্রহ ছাড়াও কিছু মহাজাগতিক বস্তু সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে।

 

সৌরজগতের গঠন

বর্তমান ধারণা অনুযায়, সৌরজগত গঠিত হয়েছে ৮টি গ্রহ ও তাদের অন্তর্গত বেশ কিছু উপগ্রহ, বামন গ্রহ, এবং অসংখ্য ক্ষুদ্র বস্তু নিয়ে।

সৌরজগতের প্রাণকেন্দ্র সূর্য। এটিই সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। সৌরজগতের মোট ভরের শতকরা ৯৯.৮৬ ভাগের জন্য দায়ী সূর্য। এই ভরের কারণে অভ্যন্তরভাগে বিপুল ঘনত্বের সৃষ্টি হয় এবং নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়া ঘটে। ফলে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় যার অধিকাংশ বিভিন্ন তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ যেমন দৃশ্যমান বর্ণালী হিসেবে মহাকাশে নির্গত হয়।

 

গ্রহ-উপগ্রহ সমূহের বর্ণনা

সূর্য থেকে দুরত্বের ক্রমানুসারে সৌরজগতের গ্রহসমূহ হচ্ছে বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুন।

 

সৌরজগতের গ্রহসমূহ
সৌরজগতের গ্রহসমূহ

 

গঠন অনুসারে এদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম চারটি হচ্ছে শিলাময় গ্রহ এবং শেষের চারটি দানব গ্রহ।

 

শিলাময় গ্রহ

শিলাময় গ্রহগুলো প্রধানত শিলা ও ধাতু দ্বারা গঠিত। অন্তঃস্থ এই চারটি গ্রহ বহিঃস্থ গ্রহ চারটির তুলনায় ক্ষুদ্রতর। এদের পৃষ্ঠভাগ শক্ত, উপগ্রহ কম বা নেই।

সূর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং গ্রহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্রত্তম গ্রহ বুধ। সূর্য হতে এর গড় দুরত্ব ৫.৮ কোটি কিমি। প্রায় ৩ মাসে এটি সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে।

তারপর শুক্র। বুধ এবং শুক্র গ্রহের কোন উপগ্রহ নেই। শুক্র সৌরজগতের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও উত্তপ্ত গ্রহ। ভোরের আকাশে আমরা একে শুকতারা এবং সন্ধ্যার আকাশে সন্ধ্যাতারা রূপে দেখি।

সূর্য থেকে দুরত্বের ক্রমানুসারে তৃতীয় গ্রহ হলো আমাদের পৃথিবী। পৃথিবীর একটি প্রাকৃতিক উপগ্রহ রয়েছে যাকে আমরা চাঁদ বলে ডাকি। পৃথিবীর জলভাগের কারণে সৌরজগতের গ্রহসমূহের মধ্যে একমাত্র পৃথিবীতেই রয়েছে জীবন ধারণের অনুকূল পরিবেশ। একমাত্র পৃথিবীতেই প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে।

তারপর মঙ্গল গ্রহ। ধারণা করা হয় ৩.৫ বিলিয়ন বছর পূর্বে মঙ্গল গ্রহেও জীবনের অস্তিত্ব ছিল। তবে এখন আর নেই। অত্যাধিক আয়রণ অক্সাইডের কারণে মঙ্গলকে লাল গ্রহও বলা হয়। ফোবস ও ডিমোস নামে মঙ্গলের দুটি উপগ্রহ আছে।

 

মঙ্গল এবং বৃহস্পতি তথা শিলাময় গ্রহ ও দানব গ্রহের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত এস্ট্রয়েড বেল্ট।

 

দানব গ্রহ

দানব গ্রহ চারটি হচ্ছে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস এবং নেপচুন।

শিলাময় গ্রহগুলির তুলনায় এরা অনেক বেশি ভরযুক্ত। এদের মধ্যে বৃহস্পতি ও শনি বৃহত্তম দুটি গ্রহ। মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস দ্বারা গঠিত বলে গ্রহদ্বয় গ্যাস দানব নামেও পরিচিত। সমগ্র সৌরজগতের ভরের অধিকাংশ অংশই রয়েছে সূর্যে এবং অবশিষ্ট ভরের শতকরা ৯০ ভাগের জন্য দায়ী হলো বৃহস্পতি এবং শনি। বৃহস্পতি গ্রহের ৬৭টি প্রাকৃতিক উপগ্রহ আছে। বৃহত্তম উপগ্রহ গ্যানিমেডের আকার বুধ গ্রহ থেকেও বড়।

তারপর শনি। দৃষ্টিনন্দন বলয়ের জন্যই গ্রহটি বেশি পরিচিত। এই বলয় পৃথিবী থেকে দেখা যায়। শনির টাইটান উপগ্রহটিও বুধের চেয়ে বড়। এটি সৌরজগতের একমাত্র উপগ্রহ যাতে উল্লেখযোগ্য পুরুত্বের বায়ুমণ্ডল আছে। টাইটানের পৃষ্ঠে তরল পদার্থেরও সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।

সর্ববহিঃস্থ গ্রহদ্বয় ইউরেনাস ও নেপচুন তুষার দৈত্য নামে পরিচিত। এগুলির প্রধান উপাদান জল, অ্যামোনিয়া ও মিথেনের মতো উদ্বায়ী পদার্থ। নেপচুন দুরত্বের ক্রমানুসারে সূর্য থেকে সবচেয়ে দুরবর্তী গ্রহ। সূর্য থেকে এর গড় দুরত্ব ৪৫০ কোটি কিমি।

 

নেপচুনের বাইরের দিকে অবস্থিত কাইপার বেল্ট নামক আর একটি বেষ্টনী। তারপর অর্ট ক্লাউড। এটিই সৌরজগতের র্সশেষ সীমানা।

সৌরজগতের ক্ষুদ্র বস্তু সমূহ রয়েছে এস্ট্রয়েড বেল্ট, কাইপার বেল্ট এবং অর্ট ক্লাউডে। আর বামন গ্রহসমূহের মধ্যে রয়েছে প্লুটো, সেরেস, হাউমেয়া ইত্যাদি। উল্লেখ্য প্লুটোকে পূর্বে সৌরজগতের একটি গ্রহ মনে করা হতো। কিন্তু গ্রহের সকল বৈশিষ্ট্য না থাকায় বর্তমানে একে বামন গ্রহের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

……….

যা হউক এই ছিল সৌরজগতের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। সৌরজগত, যা পৃথিবীর তুলনায় ৩৬ বিলিয়ন গুন বড়; তা মহাবিশ্বের তুলনায় অতি নগন্য। মহাবিশ্ব এতই বড় যে, কোন কারণ ছাড়াই সৌরজগৎ উধাও হয়ে গেলে মহাবিশ্বে তার কোন প্রভাবই পড়বে না। সেই সুবিশাল মহাবিশ্বে পৃথিবীর অবস্থান জানাটা সত্যিই রোমাঞ্চকর। মহাবিশ্বে পৃথিবীর অবস্থান জানতে দর্শক ‘মহাবিশ্বের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা’ এই অনুচ্ছেদটি পড়তে পারেন।

সম্পর্কিত অনুচ্ছেদসমূহ