প্রস্তাবনা:
প্রতিটি আইনের শুরুতেই প্রস্তাবনা থাকে। একে ঘোষণা বলা যায়। প্রস্তাবনার মাধ্যমে সংবিধানের মৌল নীতিমালা, মূলনীতি, রাষ্ট্রের লক্ষ্য, সংবিধান প্রণেতাদের আদি-ইচ্ছা ইত্যাদি জানা যায়।
প্রস্তাবনাকে সংবিধানের দর্পণ এবং গাইডিং স্টার বলা হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের শুরুতে লেখা আছে “বিস্মিল্লাহির-রহ্মানির রহিম”। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই শব্দগুচ্ছ যুক্ত করা হয়েছে।
তারপর ‘প্রস্তাবনা’ শিরোনাম দিয়ে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।
……………………….
বিস্মিল্লাহির-রহ্মানির রহিম
(দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে)/
পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে।
প্রস্তাবনা
আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি;
আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল-জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে;
আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;
আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সঙ্গতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেইজন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য;
এতদ্বারা আমাদের এই গণপরিষদে, অদ্য তের শত ঊনআশী বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের আঠারো তারিখ, মোতাবেক ঊনিশ শত বাহাত্তর খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের চার তারিখে, আমরা এই সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করিয়া সমবেতভাবে গ্রহণ করিলাম।
………………………..
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা:
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার পাঁচটি অংশ রয়েছে।
প্রথম অংশে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ আছে।
দ্বিতীয় অংশে সংবিধানের চারটি মূলনীতি; তথা জাতীয়বাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে।
তৃতীয় অংশে রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। তা হলো এমন এক শোষণমুক্ত সমাজ যেখানে আইনের শাসন, মানবাধিকার, সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার থাকবে।
চতুর্থ অংশে আমাদের পবিত্র কর্তব্য; তথা সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং তার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে।
পঞ্চম অংশে সংবিধান গ্রহণ করার তারিখ (১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর) উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার মূল বিষয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। নিচে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা হলো:
১. প্রস্তাবনা থেকে আমরা সংবিধান রচনার প্রেক্ষাপট ও পটভূমি জানতে পারি।
২. সংবিধানের মূলনীতি সম্পর্কে জানতে পারি।
৩. রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে পারি।
৪. সংবিধান প্রণয়নের আইনগত ভিত্তি সম্পর্কে ধারণা দেয়।
৫. প্রস্তাবনা সংবিধান প্রণয়নকারীদের ইচ্ছাকে তুলে ধরে। তাই একে সংবিধানের দর্পণ বলা হয়।
৬. প্রস্তাবনা সমগ্র জাতির জন্য একটি দিক নির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। সংবিধানের কোন অংশে অস্পষ্টতা দেখা দিলে তা দূরকরণে দিক নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। তাই একে সংবিধানের গাইডিং স্টার বলা হয়।
অতএব সংবিধানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।