বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত ইরাক ও ইরানের যায়গাগুলোকেই বলা হতো মেসোপটেমিয়া। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে মেসোপটেমিয়ায় যে সভ্যতার জন্ম নিয়েছিল তাকে বলা হয় মেসোপটেমিয়া সভ্যতা। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। সভ্যতার আতুঁড়ঘর বলা হয় একে। কারণ মেসোপটেমিয়া সভ্যতা থেকেই অন্যান্য অনেক সভ্যতার জন্ম হয়। ‘মেসোপটেমিয়া (Mesopotamia)’ কথাটির অর্থ, দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল। ‘মেসো’ অর্থ ‘দুই’ এবং ‘পটেমিয়া’ অর্থ ‘নদী’। এই নদী দুটি হচ্ছে ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস। নদী দুটি এখনও আছে তবে তাদের গতিপথ পরিবর্তীত হয়ে গেছে। যা হউক সভ্যতাটি পরিপূর্ণতা লাভ করে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে ।
মেসোপটেমিয়া সভ্যতার চারটি ভাগ ছিল:
- সুমেরীয় সভ্যতা,
- ব্যাবিলনীয় সভ্যতা,
- আসিরীয় সভ্যতা এবং
- ক্যালডীয় সভ্যতা।
খ্রিস্টপূর্ব ৪২৩৬ অব্দ থেকে ব্যাবিলনীয়রা সর্বপ্রথম ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু করেছিল। কিন্তু সেকালের ক্যালেন্ডার সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি।
মাসের ধারণা
ব্যাবিলনীয়রা লক্ষ্য করেছিল যে চাঁদ এক অবস্থা থেকে একটি পূর্ণ চক্র সম্পন্ন করে আবার সেই অবস্থায় আসতে ৩০ দিন সময় নেয়। যেখানে সেই সময়ে সে পৃথিবীকে ১ বার প্রদক্ষিণ করে। সেই থেকে এই ত্রিশ দিনকে তারা আলাদা করে গণনা শুরু করে। ইংরেজি ভাষায় চাঁদের প্রতিশব্দ ‘মুন’ (Moon)। এটিই বর্তমানে পরিবর্তীত হয়ে ‘মান্থ’ (Month) বাংলায় ‘মাস’ নামে প্রচলিত আছে।
তারা মাসের বিভিন্ন সময়কে চিহ্নিত করত চাদেঁর ধীরে ধীরে বেড়ে উঠার ছবি দেখে।
- চাদঁ উঠার সময়: ক্যালেন্ডস
- পুরু চাদঁ: ইডেস
- মাঝামাঝি চাদঁ: নুনেস।
শুরু হলো মাসকে ভাগ করা তথা সপ্তাহের ধারণা। সপ্তাহ নিয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তাই এখন আর আলোচনা করা হবে না।
বছরের ধারণা
ব্যাবিলনীয়রা খেয়াল করল প্রকৃতি কখনও রুক্ষ হয়ে যায়, গাছের পাতা ঝরে যায়। কিছুদিন থাকে তারপর আবার গাছে নতুন পাতা হয়। কখনও প্রচন্ড রোদ থাকে, আবার কখনও প্রচুর বৃষ্টি হয়। তারা বুঝতে শুরু করল প্রকৃতির সাথে এসব বিষয় চক্রাকারে ঘটে। প্রচন্ড রোদ, তারপর বর্ষা, তারপর শীতের রুক্ষতা, সবশেষে বসন্ত, তারপর আবার প্রচন্ড রোদ; এ ঘটনাগুলো পর্যায়ক্রমে ঘটতেই থাকে। তাদের এ বিষয় সমূহের প্রতি নজর দেওয়ার কারণ কৃষিকাজ। তারা লক্ষ করেছিল কোনো কোনো সময় বীজ বপন করলে ভাল ফসল হয়, আবার কখনও হয় না। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী কৃষিকাজ করলে ভালো ফসল হয়। অতএব কৃষকদের ফসল ফলানোর জন্য সঠিক সময় নির্ণয়ের প্রয়োজন ছিল। আর এ প্রয়োজনীয়তাই বর্ষ গণনার মূল কারণ ছিল ।
তখনকার ধারণা ছিল যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। সূর্যের ঘূর্ণনের ফলেই প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ তথা ঋতুর উদ্ভব হয়। ফসল ফলানোর জন্য ঋতু গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই সূর্যের ঘূর্ণনকেও গণনা করা প্রয়োজন ছিল। প্রকৃতি এক রূপ থেকে পরিবর্তীত হয়ে আবার সেই রূপে ফিরে আসতে তথা এক ঋতু থেকে আবার সেই ঋতুতে ফিরে আসতে যতটুকু সময় লাগত তাকে ব্যবিলনীয়রা হিসাব করত একটি চক্র রূপে। এটিই বর্তমান হিসেবে এক বছর। যদি প্রতি ঋতুর স্থায়িত্ব হয় চন্দ্রের ২ বার আবর্তনের সমান মানে ২ মাস এবং এক চক্রে ছয়টি ঋতু থাকে; তবে এক চক্র তথা এক বছর সমান হয় ৬*২=১২ মাস। দিনের হিসাবে যা ১২*৩০=৩৬০ দিন। অনেকের ধারণা এখান থেকেই বৃত্তকে ৩৬০ ভাগে তথা ডিগ্রিতে ভাগ করার ধারণা আসে।
অতএব চন্দ্রের উপর ভিত্তি করে মাস গণনা এবং সূর্যের উপর ভিত্তি করে বছর গণনার সূচনা হয় প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার ব্যাবিলনীয়দের হাত ধরেই।
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে ব্যাবিলনীয়রা সর্বপ্রথম ‘বর্ষবরণ’ উৎসব পালন শুরু করে। বসন্তের প্রথম দিনে শীতের রুক্ষতাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে প্রকৃতি যখন নতুন রূপে সাজে তখনই শুরু হতো কৃষকদের এই বর্ষবরণ উৎসব। চলত টানা ১১ দিন। এভাবেই শুরু হয়ে যায় আনন্দের বর্ষবরণ উৎসব। যা পরিবর্তীত হয়ে এখনও প্রচলিত আছে।
যা হউক সময় বইতেই থাকল। দিন, মাস, বছর এগুলোর উদ্ভব হয়ে গিয়েছিল। তাই পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু করে বর্ষ গণনা। পরবর্তী অনুচ্ছেদ থেকে আমরা সেসব বিষয় সম্পর্কে জানব।