অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান:
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তখন দেশ ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলে।
দেশকে শত্রুমুক্ত করতে ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নামানুসারে এই সরকারকে ‘মুজিবনগর সরকার’ বলা হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের ‘প্রথম অন্তর্বতীকালীন সরকার’। বঙ্গবন্ধু তখন ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। তাই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে।
মুজিবনগর সরকার ১০ই এপ্রিল বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ জারি করে। এটি ছিল ‘প্রথম অন্তর্বতীকালীন সংবিধান’।
১৭ই এপ্রিল এই সরকার শপথ গ্রহণ করে; যার মূল দায়িত্ব ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা।
স্বভাবতই পাকিস্তানিরা মুজিবনগর সরকারকে মেনে নেয়নি। হানাদার বাহিনী অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের উপর আক্রমণ করে। বাংলাদেশ সরকার আশ্রয় নেয় ভারতে। সেখান থেকেই বাংলাদেশ সরকারের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়।
২২ ডিসেম্বর অস্থায়ী সরকার ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে এবং ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে।
১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ জারি করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটি ছিল ‘দ্বিতীয় অন্তর্বতীকালীন সংবিধান’।
অস্থায়ী সংবিধান আদেশের বিভিন্ন দিক:
- রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন। যার অর্থ হচ্ছে দেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার থাকবে। প্রধানমন্ত্রী হবেন এর প্রধান। রাষ্ট্রপতি হবেন নামমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান।
- বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য একটি ‘গণপরিষদ’ গঠিত হবে।
১২ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে অর্থমন্ত্রীর দ্বায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি এ পদে আসীন ছিলেন।
১৯৭২ সালের ২৩শে মার্চ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরি ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ’ নামে একটি আদেশ জারি করেন।
এটি ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর করা হয়। এই আদেশ বলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণ গণপরিষদের সদস্য বলে পরিগণিত হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় অন্তর্বতীকালীন সরকার’। জাতীয় পরিষদের ১৬৯ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ জন; মোট ৪৬৯ জন সদস্যের মধ্যে বিভিন্ন কারণে কিছু সদস্য বাদ পড়ে।
গণপরিষদের সদস্য ছিল ৪০৩ জন।
পরিষদের নেতা: শেখ মুজিবুর রহমান
স্পিকার: শাহ আব্দুল হামিদ
ডেপুটি স্পিকার ; মুহম্মদ উল্লাহ
সংবিধান প্রণয়ন করাই ছিল গণপরিষদের মূল লক্ষ্য।
১০ই এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে।
১১ই এপ্রিল তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাই ড. কামাল হোসেনকে বাংলাদেশের সংবিধানের জনক বা রূপকার বা স্থপতি বলা হয়।
কমিটির একমাত্র মহিলা সদস্য ছিলেন বেগম রাজিয়া বানু।
কমিটির একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন ন্যাপ (মোজাফফর) এর সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত।
১৭ই এপ্রিল থেকে ৩রা অক্টোবর পর্যন্ত এই কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক হয়। জনগণের মতামত সংগ্রহের জন্য আহ্বান করা হয়। সংগৃহীত মতবাদ থেকে ৯৮টি সুপারিশ গ্রহণ করা হয়। ১১ই অক্টোবর কমিটির খসড়া সংবিধান প্রণয়নের কাজ শেষ হয়।
১৯৭২ সালের ১২ই অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে উত্থাপন করেন। ১৯শে অক্টোবর থেকে বিল সম্পর্কে গণপরিষদে আলোচনা শুরু হয়।
১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর, বাংলা ১৩৭৯ বঙ্গাব্দের ১৮ই কার্তিক বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে এই সংবিধান গৃহীত হয়। এ কারণে ৪ঠা নভেম্বর “সংবিধান দিবস” হিসাবে পালিত হয়।
গণপরিষদের সদস্যরা ১৪ই ডিসেম্বর মূল সংবিধানে স্বাক্ষর করেন। ৩৯৯ জন সদস্য স্বাক্ষর করলেও সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত হস্তলিখিত মূল সংবিধানে স্বাক্ষর করেননি।
১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ১ম বার্ষিকী হতে এটি কার্যকর হয়।
উল্লেখ্য পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন হওয়ার পর সংবিধান রচনা করতে ৯ বছর সময় লেগেছিল। ভারতের লেগেছিল ২ বছর। সেখানে অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে মাত্র ৯ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছিল।
গণপরিষদে সংবিধানের উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন,
“এই সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত, এ সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে।”
বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার সময়-
রাষ্ট্রপতি: আবু সাঈদ চৌধুরি
প্রধানমন্ত্রী: শেখ মুজিবুর রহমান
গণপরিষদের-
সংসদ সদস্য: ৪০৩ জন
প্রথম অধিবেশনের সভাপতি: মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ
প্রথম স্পিকার: শাহ আব্দুল হামিদ
প্রথম ডেপুটি স্পিকার: মোহাম্মদ উল্লাহ
বাংলাদেশ গণপরিষদের সংসদ নেতা: শেখ মুজিবুর রহমান
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য: ৩৪ জন
সংবিধান প্রণেতা ও খসড়া সংবিধান কমিটির প্রধান: ড. কামাল হোসেন
মূল সংবিধান ইংরেজি ভাষায় রচিত হয়েছে। এর বাংলা ভাষারূপ পর্যালোচনার জন্য ড. আনিসুজ্জামানকে আহ্বায়ক, সৈয়দ আলী আহসান এবং মযাহারুল ইসলামকে ভাষা বিশেষজ্ঞ হিসাবে একটি কমিটি গঠন করে পর্যালোচনার ভার দেওয়া হয়। তবে অর্থগত বিরোধ হলে বাংলা গৃহীত হবে।
গণপরিষদের ভবন, যা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন, সেখানে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির বৈঠকে সহযোগিতা করেন ব্রিটিশ আইনসভার খসড়া আইন প্রণেতা আই গাথরি।
সংবিধান ছাপাতে ১৪ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল। সংবিধান অলংকরণের জন্য ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল যার প্রধান ছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। এই কমিটির সদস্য ছিলেন শিল্পী হাশেম খান, জনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী ও আবুল বারক আলভী। শিল্পী হাসেম খান অলংকরণ করেছিলেন। হস্তলিখিত সংবিধান ছিল ৯৩ পাতার। তবে স্বাক্ষরসহ ১০৯ পাতা হয়েছিল।
মূল লেখক: শিল্পী আব্দুর রউফ
অঙ্গসজ্জায়: হাশেম খান
সার্বিক তত্ত্বাবধানে: শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন
১৯৪৮ সালের তৈরি ক্র্যাবটি ব্র্যান্ডের দুটি অফসেট মেশিনে সংবিধানটি ছাপা হয়।
সংবিধানের মূল কপিটি বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।